ভারতীয় ধরন আশঙ্কাজনকভাবে ছড়াতে শুরু করেছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে
করোনাভাইরাসের যে ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) কারণে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে সেই ধরন বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে আগামীতে যে টিকাগুলো দেয়া হবে সেগুলো এই ধরনের বিরুদ্ধে কাজ করবে কিনা তা নিয়ে এখনো সংশয় রয়েছে। এরইমধ্যে বাংলাদেশে মার্কেট, রাস্তাঘাট, ফেরি সবখানে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সে কারণে এমনিতেই দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে, এরইমধ্যে ভারতীয় ধরন শনাক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন ধরন নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও।
ভারত থেকে যশোর ও বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা আটজনের নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের শরীরে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, 'আইইডিসিআর এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আটজনের নমুনা পরীক্ষা করে দুটি নিশ্চিত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ও চারটি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কাছাকাছি ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করেছে'।
নাসিমা সুলতানা বলেন, 'সম্পূর্ণ জিনোম সিকুয়েন্সিং এখনো শেষ হয়নি। সম্পূর্ণ জিনোম সিকুয়েনস্সিং না হলে এখনো বলা যাবেনা ডাবল নাকি ট্রিপল ভ্যারিয়েন্ট'।
তিনি আরো বলেন, 'ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া সবাই চিকিৎসাধীন আছে, কারো অবস্থায়ই খারাপ নয়। এ ভ্যারিয়েন্ট দেশে ছড়িয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষার ওপর নির্ভর করবে। যে কয়েকজনের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের মধ্যে এ ফলাফল পাওয়া গেছে'।
নাসিমা সুলতানা বলেন, 'এ ভ্যারিয়েন্ট অনেক বেশি সংক্রামক। নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উদ্বিগ্ন ও সারাদেশের মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যবিধি মানার এখনই সময়'।
বাংলাদেশ সরকার ২৬ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে; কিন্তু তবুও কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকায় অনেক বাংলাদেশি ভারত থেকে দেশে ফিরতে পেরেছেন এবং তাদেরকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায় যে ইতিমধ্যেই ডজনখানেক দেশে ভারতীয় কোভিড ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।
এই মূহুর্তে ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গ সুনামির মত আছড়ে পড়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই সংক্রমণের নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে ভারত।
ভারতে ভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গ এতটাই হিংস্র রূপে দেখা দিয়েছে যে দেশটির হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন, শয্যা ও অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় বহু রোগীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে হাসপাতালগুলো।
ভারতের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার ভারতে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৪০১,০৭৮ জন। ফলে এখন পর্যন্ত তাদের মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২১ দশমিক ৮ মিলিয়ন।
শুক্রবার ভারতে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন ৪,১৮৭ জন এবং সর্বমোট ২৩৮,২৭০ মৃত্যু নিয়ে তাদের মৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ০৯ শতাংশে।
এখনো পর্যন্ত ১৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন মানুষ করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন এবং ভারতে সর্বমোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩,৭২৩,৪৪৬ জন।
ভারতীয় ধরনটি ইতিমধ্যেই ভারতের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিবেশি দেশ নেপালের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক এবং ধারণা করা হচ্ছে সেখানেও ভারতের মত বিপর্যয় ঘটতে পারে।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ইতিমধ্যেই ব্যাপক করোনা সংক্রমণ দেখা দিয়েছে এবং হাসপাতালগুলো রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
প্রথিতযশা ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'ভারতীয় ধরন অনেক বেশি সংক্রামক ও শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। তাই আমাদের এখন বর্ডার এলাকায় পরীক্ষা বাড়াতে হবে ও বিদেশ ফেরতদের ১৪ দিনের আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। ইতালি ফেরতদের কোয়ারেন্টাইন করতে যে ভুল হয়েছে গতবার, সেই ভুল এবার আর করা যাবেনা। এছাড়া হাসপাতালগুলোকে এখন প্রস্তুত করতে হবে এবং অক্সিজেনের মজুদ বাড়াতে হবে'।
লকডাউনের মধ্যেও দেশে মানুষের চলাচল থেমে নেই। এর ফলে সংক্রমণ আবার বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের অন্যতম উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন টিবিএসকে জানান, 'দুই সপ্তাহ আগে নেয়া পদক্ষেপের কারণে দেশে এখন সংক্রমণ ও মৃত্যু কমেছে। কিন্ত মার্কেট, ফেরি, মসজিদে এখন যে ভিড় বাড়ছে এর ফলে দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণ আবার বাড়বে। এর মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নতুন একটা উদ্বেগ। এখন স্থল বন্দর দিয়ে যারা দেশে আসবে তাদের কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। কেউ পজেটিভ শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে, কন্টাক্ট ট্রেসিং করতে হবে। আর সংক্রমণ রোধে শতভাগ মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে'।
ভারতীয় ধরনের ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা এখনো অজানা
ভারতে এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় ধরনের বিপরীতে ওই দুই ভ্যাকসিন কাজ করে বলে জানিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশে এখন কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দেয়া হলেও ভ্যাকসিন সংকটের কারণে শিগগিরই এই ভ্যাকসিন দেয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আগামীতে দেশে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সেসব ভ্যাকসিন ভারতীয় ধরনের বিপরীতে কাজ করবে কিনা তা নিয়ে এক ধরণের অজানা ঝুঁকি রয়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান।
তিনি বলেন, 'স্পুটনিক বা সিনোফার্ম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর নাকি অকার্যকর তা নিয়ে এখনো কোন গবেষণা হয়নি। তাই কিছুটা ঝুঁকি রয়ে গেছে। তবে মন্দের ভালো একটি বিষয় হলো বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (B.1.617.2) E484K মিউটেশনটি নেই। এটা থাকলে খুব ক্ষতিকর হতে। এখানে টিকা কাজ করবে বলে এখনো মনে হচ্ছে। মাস্ক সব ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ ঠেকাতে পারে। তাই মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে'।
৫৫ দিনে সর্বনিম্ন শনাক্ত, আরও ৪৫ মৃত্যু
গত ২৪ ঘণ্টায় কোভিড-১৯ কেড়ে নিয়েছে আরও ৪৫ জনের প্রাণ। এ নিয়ে দেশে কোভিড মহামারিতে মোট মৃত্যু ১১ হাজার ৮৭৮ জনে উন্নীত হলো বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত এক বছরে যত মানুষ করোনাভাইরাসে শনাক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে এই রোগে।
গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছেন ১,২৮৫ জন। গত মার্চ মাস থেকেই দেশে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। বিগত ৫৫ দিনে এটিই সর্বনিম্ন আক্রান্তের সংখ্যা। সরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৭,৭২,১২৭ জন।
তবে গতকাল (শনিবার) কোভিড পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার হার কমে ৮.৭৪ শতাংশে দাঁড়ায়, যা একদিন আগেই ছিল ৯.৮৯ শতাংশ।