ভারত থেকে আগত সত্যিকার ঝুঁকি কি চিহ্নিত হচ্ছে?
আপনি যদি এখনো পর্যন্ত B.1.617 এর নাম নাও শুনে থাকেন, খুব শীঘ্রই শুনবেন। কারণ প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলমান করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের বিভীষিকার পেছনে এই ভ্যারিয়েন্টটিই দায়ী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা B.1.617 কে 'ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন' থেকে 'ভ্যারিয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট'- বলে চিহ্নিত করেছে। ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও একাধিক শর্তের উপর নির্ভর করে এই ভ্যারিয়েন্টকে বিচার করছেন। যেমন- এটি কত দ্রুত ছড়ায়, কত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় কিংবা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা গেলেও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় কিনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবছেন তারা।
ভারতে চলমান করোনা বিপর্যয়ের সত্যিকার রূপ উন্মোচনের মধ্যে দিয়েই ভ্যারিয়েন্টটি মানুষের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দৈনিক ৪০০০ মৃত্যু এবং ৪০০,০০০ শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে ভারতে। অথবা এই সংখ্যা ২৫ হাজার মৃত্যু এবং ২ থেকে ৫ মিলিয়ন করোনা আক্রান্তও হতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্রাউন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর আশিষ ঝা। এই মুহূর্তে পুরো বিশ্বকেই ভারতের এই বিপর্যয় মোকাবিলায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে হবে এবং তা তাদের নিজেদের স্বার্থেই।
ভাইরাসের মধ্যে নানারকম পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি বিষয় হলো-স্পাইক প্রোটিনের একটি অংশ যা 'রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন' নামে পরিচিত। এটিই মূলত মানবদেহের কোষের মধ্যে ভাইরাস ঢুকে যেতে দেয়। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে যে B.1.617 স্পাইক প্রোটিন দ্বারা ভাইরাস ঢুকলে তা 'ফাইজার-বায়োএনটেকের উদ্ভাবিত BNT162b2 ভ্যাকসিন (প্রাতিষ্ঠানিক নাম) দ্বারা শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আংশিকভাবে বাধা দিতে সক্ষম।' যদিও ভারতে ফাইজার ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে না, বরং এটি উন্নত দেশগুলোয়ই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে এই সুযোগ মোকাবিলায়। যদিও এই মুহূর্তে তারা অক্সিজেন, শয্যা ও অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের স্বল্পতা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, কিন্তু নয়াদিল্লীকে অবশ্যই নিজেদের ও বিশ্ববাসীর স্বার্থে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝার জন্য জিনোম পর্যবেক্ষণ শুরু করতে হবে। পুনরায় এটি চালু করার পরিকল্পনাও চলছে এবং অনেক অর্থনৈতিক খাতের চাঙ্গা হয়ে ওঠা এর উপর নির্ভর করবে।
ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে ভ্যাকসিনের এই লড়াইয়ের ঘটনা নতুন নয়। গবেষকরা যুক্তরাজ্যের B.1.1.7 এবং দক্ষিণ আফ্রিকার B.1.351 থেকে শুরু করে ব্রাজিলের P.1 এবং B.1.429 এবং ক্যালিফোর্নিয়ার B.1.232 ভ্যারিয়েন্ট পর্যন্ত সবকিছু খুঁটিয়ে দেখেছেন। এখনো পর্যন্ত এদের সম্পর্কে ইতিবাচক খবরই পাওয়া গেছে। ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের একজন ফার্মাসিউটিক্যালস বিশ্লেষক, স্যাম ফাজেলি বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মারাত্মক উপসর্গ দেখা না দেয় কিংবা হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন না পড়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্বেগের কারণ নেই।
নয়াদিল্লীর একটি বিশেষায়িত ডায়াবেটিস ট্রিটমেন্ট সেন্টারের নার্স, মেডিক্যাল স্টাফ ও ডাক্তার মিলিয়ে ১২৩ জনের উপর করা একটি ছোট গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে তাদের মধ্যে থেকে ভ্যাকসিন নেয়া ১২৩ কর্মীর মধ্যে ১৮ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন এবং শুধু একজনকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। কিন্তু এই দলটির কেউ B.1.617. এর সংস্পর্শে এসেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। ভারতের এই বিপর্যয়ের মধ্যে শুধু ওই একটিমাত্র বিষয় জানা যায়নি।
মানুষ অক্সিজেন আর হাসপাতালে শয্যা পাওয়ার জন্য রীতিমতো লড়াই করছে। আর যদি সুস্থ হয়ে থাকে, তাহলে তারা চাইছে ভ্যাকসিন। শ্মশানগুলো দাহ করে কুলোতে পারছে না এবং অতি দরিদ্ররা বা ভীত গ্রামবাসীরা লাশ দাহও করছে না, বরং নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ঠিক যেমন তাদের পূর্বসূরীরা ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু এর সময় করেছিল বলে ঐতিহাসিক চিন্ময় টুম্বে তার 'দ্য এজ অফ প্যানডেমিকস' বইয়ে লিখেছেন।
১৪০ কোটি মানুষের দেশে যদি এই করোনাভাইরাসকে স্রেফ তার পথেই বাধাহীনভাবে চলতে দেয়া হয়, তাহলে তা হবে চরম বিপদজনক। ভারত করোনার স্বিতীয় তরঙ্গ থামাতে যত সময় নিবে, ততই এই ভ্যারিয়েন্ট ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাকে ঠেকিয়ে দেয়ার সুযোগ পাবে।
মানবজাতির এক-ষষ্ঠাংশকে বাদ দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকেও তার আগের গতিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ সব বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক চুক্তির সঙ্গে ভারতীয়রা জড়িয়ে আছেন, যারা এই মুহূর্তে নিজেদের জীবন নিয়েই ভীত। তাই ভারতের পরিস্থতি ঠিক না করে বাণিজ্যকে সুস্থ-স্বাভাবিক করে তোলা সম্ভব নয়।
এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বিপদ নিঃসন্দেহে আরো বেশি। থাইল্যান্ড ইতিমধ্যেই ভারতের পর বাংলাদেশ, নেপাল, ও পাকিস্তানের সঙ্গেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অস্ট্রেলিয়া এতটাই ভীত যে তারা ভারতফেরত নিজ নাগরিকদেরও দেশে প্রবেশ করতে দিতে চাইছে না। দুবাই থেকে ভারতীয় এক ইঞ্জিনিয়ার হংকং-এ গিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং তার দ্বারা আরো ১২০০ জনের মধ্যে ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ছড়াতে পারে মনে করে তাদেরও কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
সূত্র- ব্লুমবার্গ