ঈদ
এই লেখাটির শিরোনাম হতে পারত কাজী নজরুল ইসলামের ৯০ বছর আগের সেই গানটির প্রথম পঙক্তি: ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুলিশ ঈদ। কিন্তু করোনাকাল খুশি ম্লান করে দিয়েছে। ২০২০-র ঈদোৎসবেরই পুনরাবৃত্তি।
পৃথিবীকে ব্ল্যাক ডেথ কলেরা ও বসন্ত মহামারী স্প্যানিশ ফ্লু, এইডসসহ বিভিন্ন মহামারী ও বিশ্বব্যাধি অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। ২০১৯-র শেষ দিন যখন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ঘাতক ব্যাধি কোভিড-১৯ সম্পর্কে অবহিত হয় এর পরিণতি কি হবে কেউ অনুমানও করতে পারেননি। কোনো সন্দেহ নেই এই দুর্যোগকেও সুযোগসন্ধানীচক্র তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরেছে। আশঙ্কার দিন শেষ হচ্ছে না, প্রতিবেশী দেশে করোনার যে ভ্যারিয়েন্ট প্রবল দাপটে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে সীমান্তের দেশ হিসেবে আমাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। পৃথিবীতে ২৬০ মিলিয়ন মানুষ করোনাক্রান্ত মৃত্যুর মিছিল ৩.৩ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে চলেছে।
সিপিডির সমীক্ষায় উঠে এসেছে দেশের ৮৬ ভাগ কর্মজীবীর আয় কমে এসেছে। প্রবাসী রেমিট্যান্স ছাড়া আর কোনো খাত্ স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কোনো না কোনো ভাবে কর্মচ্যুত ৬০ ভাগের বেশি মানুষ, ৫২ ভাগ মানুষ নিত্যকার খাবার কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
কাজেই করোনা সংক্রমণ সম্ভাবনা, লকডাউন, উৎপাদন ঘাটতি উচ্চ দ্রব্যমূল্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য যেন ঈদ নয় সারাজীবনের রোজাই নিশ্চিত করে রেখেছে। তারপরও পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসবটিতে বিপন্ন মানুষের সহমর্মী হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোই হয়ে উঠবে শ্রেষ্ঠ উপাসনা। ঈদের আনন্দের এটিই হবে শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
দুর্যোগেও মানুষ আশায় ঘর বাধে, পুরোনো দিনের সুখ স্মৃতি মনে করে। কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থে নাজির হোসেন ১৬৪০ সালে ধানমন্ডিতে শাহ সুজার নির্দেশে যে ঈদগাহ নির্মিত হয়েছিল সে সম্পর্কে লিখেছেন :
শহরের মুসলমানগণ এখানে সমবেত হয়ে পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করতো। সে সময় ঈদগাহের উভয় দিকে শহরটির কয়েক মাইলব্যাপী বিস্তৃত ছিল। পবিত্র রমজানের দীর্ঘ একমাসব্যাপী রোজা পালনান্তে নব নব বস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মহানগরীর মুসলমানগণ আনন্দময় ঈদ উৎসব পালনের জন্য যখন এখানে সমবেশ হতেন তখন নিশ্চয়ই একটা উদ্দীপনাময় দৃশ্যের অবতারণা হতো।
ঈদের মিছিল
আহসান মোহাম্মদ নবী ওরফে জুম্মন বেপারীর মমিন মোটর কোম্পানীর মালিক দানবীর আবদুল আজিজের উদ্যোগে এবং প্রচেষ্টায় ঢাকায় ঈদের বর্ণাঢ্য মিছিলের আয়োজন করা হতো। নাজির আহমদ লিখেছেন : ঐ মিছিল ব্রিটিশ আমলের শেষ অধ্যায় থেকে চালু ছিল। প্রথমে সাদাসিধা কাসীদা পার্টির দলসমূহ আর মমিন মোটর কোম্পানীর মোটরযানগুলোকে জাহাজ প্লেন ময়ূয়ের নৌকার মত সাজিয়ে মিছিল বের করা হতো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে ঐ মিছিল রাজনৈতিক সমস্যাগুলিকে ফুটিয়ে তোলাই ছিল ঐ মিছিল : প্রধান উদ্দেশ্য।
কিন্তু দিনের গতিধারায় ঐ মিছিল ব্যক্তি সমালোচনাকর বিষয়ে পরিণত হয়। তাছাড়া মিছিলে দলাদলি মারামারি দেখা দেওয়ায় শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ ঐ মিছিল বন্ধ করে দেন। ঈদের মিছিল সাম্প্রদায়িক সঙ্কটের মুখোমুখিও হতো। তিনি লিখেছেন: 'মিছিলটি জুম্মন বেপারীর বাড়ির নিকট হতে আরম্ভ হয়ে চক-মোগলটুলি, ইসলামপুরে সদরঘাট হয়ে কাচারী নবাবপুর বংশাল হয়ে পুনঃ চকবাজারে এসে শেষ হতো। ভারত বিভাগের পূর্বে পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনকার একটি ঈদের মিছিল যখন নবাবপুর রোডের ভিতর প্রবেশ করে তখন নবাবপুরের রাস্তার দুদিকের হিন্দু ভবনগুলো থেকে ঈস্টক-বৃষ্টি, পাটা-পুতা, চৌকি, বাড়ির ভারী আসবাবপত্র মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের উপর বর্ষিত হওয়ার ফলে বহু মুসলমান খুব বৃদ্ধ আহত হয়েছে।'
কবির ঈদ স্মৃতি
এ কালের কবি শামসুর রাহমান রমজান মাসে মসজিদের ইফতার এবং ঈদের নামাজের জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন তার স্মৃতির শহর গ্রন্থে : রোজার দিনে সন্ধ্যার সময় বেশ মজা হতো। তখন যারা মসজিদে থাকত, তারা পেত ইফতারি: মুড়ি, ফুলুরি, দোভাজা ছোলা, বেগুনি ইত্যাদি মিশিয়ে দেওয়া হতো সবাইকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েও ইফতারি খেত। আমার ভারি লোভ হতো মসজিদের ইফতারি খেতে। ছেলেমেয়েরা আজান হওয়ার আগে থেকেই হুড়াহুড়ি লাগিয়ে দিত, কে কার আগে নেবে, এ নিয়ে রীতিমত একটা হুলস্থূল বেধে যেত। ইচ্ছে হতো আমিও ছুটে যাই, ছুটে যাই এদের দলে। মুসল্লিরা সামনে ইফতারি সাজিয়ে বসে রয়েছেন মসজিদের বারান্দায়। কান খাড়া রেখেছেন আজানের জন্য।
তিনি আজো উল্লেখ করেছেন : যেতাম নতুন কাপড় পরে আব্বার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে। সে কি আজকের কথা? সারি সারি লোক দাঁড়িয়ে পড়ত খোদার দরবারে সবাই একসঙ্গে ঝুঁকে সেজদা দিত মসজিদের ঠান্ডা মেঝেতে। চমৎকার ঠান্ডা।
একাত্তরের ঈদ
শহীদ মাতা জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি থেকে ঈদের দিনের উদ্ধৃতিটি প্রাসঙ্গিক, স্বাধীনতার জন্য যখন মায়েরা ছেলেরা প্রাণ দিচ্ছে তখনকার অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের ঈদ :
আজ ঈদ। ঈদের কোন আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামাকাপড় কেনা হয়নি। দরজা জানালার পর্দা কাচা হয়নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বসার ঘরে টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ জামী ঈদের নামাজ পড়তে যায়নি। কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমআই জর্দা রেধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেধেছি পোলাও, কোর্মা কোপ্তা, কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপি চুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন এক শিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।
১১শ' বছর আগে ১৩১২ বঙ্গাব্দের পৌষে কলিকাতা ১৩৯ কয়েরা রোড থেকে প্রকাশিত এবং ১৭ নন্দকুমার চৌধুরী সেকেন্ড লেন থেকে মুদ্রিত নবদূত তৃতীয় বর্ষ অষ্টম সংখ্যার সম্পাদক লিখলেন সম্পাদকীয় কবিতা :
যে উৎসবে এতখানি সাম্যভাব জাগে
হৃদে উঠে প্রীতির উচ্ছাস
সে কি শুধু বৃথা হবে? নব অনুরাগে
পুরাবে না জীবনের আশা?
ঈদ, সে ত আমাদের ঐক্য সখ্য লাগি
বর্ষে বর্ষে দেয় দরশন
প্রীতির মন্দিরে তার স্মৃতি জীয়াইয়া
এস চেষ্টা করি প্রাণপণ।
বীরেন্দ্রকুমার দত্ত 'ঈদ সম্মিলন নিয়ে কবিতা লিখলেন :
কে বলে ইসলাম সূর্য অস্তমিত পশ্চিম সাগরে
আমি তারি মহাগুড়ি হেরিতেছি প্রত্যেক অন্তরে।
সম্প্রীতি কখনো কখনো বিস্মিত হলেও ঈদোৎসব ছিল সবার জন্য। কবিতাই প্রকাশ করে দেয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐক্য ছিল ঈদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উপসংহার টেনে দেন কবি নজরুল তার গানের বাণীতেই :
তারে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়েই তোলবে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।