আদালত, তদন্ত প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতায় দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তির অচলাবস্থা
অগ্রণী ব্যাংকের মতিঝিল বাণিজ্যিক শাখার প্রায় ৭ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির দায়ে ২০০০ সালে ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপক ওমর ফারুকসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো।
২০০২ সারে ঢাকার আদালতে মামলাটির বিচার শুরু হয়। ওই বছরের অক্টোবর মাসে আসামীরা হাইকোর্র্টে রিট করে মামলাটির বিচারে স্থগিতাদেশ নেয়। এখন পর্যন্ত মামলাটির বিচারকাজ শুরু হয়নি।
কারসাজি করে ৪১ কোটি টাকা মূল্যের সরকারি জমি এক ব্যাক্তির নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার অভিযোগে ঢাকার তেঁজগাও জোনের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার মোকাম্মেল হকের বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। আসামীদের রিটের প্রেক্ষিতে ২০০০ সালে হাইকোর্টের আদেশে মামলার বিচার স্থগিত হলেও এখন পর্যন্ত ওই স্থগিতাদেশ বাতিল না হওয়ায় এখন পর্যন্ত মামলার বিচার শুরু হয়নি।
১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পযন্ত তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে করা ২০২ টি মামলার বিচার হাইকোর্টের আদেশে এখন পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে।
২০০৪ সালে 'দুর্নীতি দমন ব্যুরো' বিলুপ্ত করে 'দুর্নীতি দমন কমিশন' প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
দুদক বলেছে, স্থগিত হওয়া এসব মামলার বীপরিতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা জড়িত রয়েছে। প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, স্থগিত থাকা এসব মামলা বিচার পুনরায় চালুর বিষয়ে শীঘ্রই হাইকোর্টে আবেদন করে স্থগিতাদেশ বাতিল চাওয়া হবে।
দুদকের পরিসংখ্যানে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলা নিষ্পত্তির হারের হতাশাজনক চিত্র দেখা যায়।
দুদকের পরিসংখ্যন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি আপিলও নিষ্পত্তি হয়নি, হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র চারটি আপিল আর বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫৫ টি মামলা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে সংস্থাটির দেওয়া পরিসংখ্যন বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মোট মামলা ছিল ২৯৩১ টি। এসব মামলার বিপরীতে, আত্মসাত, পাচার, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা জড়িত।
সংস্থাটির দাবি, ২০২০ সালে বিচার সম্পন্ন হয়ে ৭১.৬১ শতাংশ মামলায় অভিযুক্তদের সাজা নিশ্চিত হয়েছে। তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এটিকে সংস্থাটির বড় সফলতা হিসেবে অখ্যায়িত করে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় বিবৃতিও দেন।
তবে দুদকের পরিসংখ্যনই বলছে, ওই বছর মাত্র ৫.২০% মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
শুধু গত বছর নয়, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে জানা যায় বিচারিক আদালতে এক যুগের (২০০৯ এর জানুযারি -২০২০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত) প্রতি বছরই মামলা নিষ্পত্তির হার একেবারেই কম।
এই 'কম নিষ্পত্তির হার' নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আইন বিশেষজ্ঞরা এটিকে 'আশ্চর্যজনক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছে, এই কম নিষ্পত্তির পেছনে সংস্থাটি মূলত দায়ী। এছাড়াও এসব মামলা নিষ্পত্তিতে আদালতেরও দায় রয়েছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, দুদক মামলা দায়ের করলে, তা তদন্ত করতেই বছরের পর বছর ব্যয় হয়।
তিনি বলেন, "দুদক পরিচালিত হওয়ার জন্য একটি আইন রয়েছে। সেই আইন খোদ সংস্থাটি কতটা মানে, তা নিয়েই প্রশ্ন আছে। অনেক বড় বড় মামলা রয়েছে নানা অজুহাতে সেগুলোর তদন্ত ৫-৭ বছর পর্যন্ত স্থগিত থাকে।" এখানেই বিচার শুরু হতে হোঁচট খাচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিচারিক আদালত ও আপিলে দুদকের মামলা নিস্পত্তির হার-কে 'হতাশাজনক' উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, দুদক বরারবই মামলা নিস্পত্তির হার ও আসামিদের সাজার হার উল্লেখ করে, তারা সফল বলে প্রচারণা করছে, এটি আসলে কিভাবে তারা দাবী করছে সেটি বোধগম্য নয়।
তিনি বলেন, "দুদক যতোটা উদ্যোগের সাথে মামলা দায়ের করে ততোটা উদ্যোগের সাথে মামলা নিষ্পত্তির জন্য মনোনিবেশ করেন না। তারা মনে করে্ন মামলা দায়ের করেই তাদের কাজ শেষ,"
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার পেছনে দুদকের দুর্বলতা মূলত দায়ী। কারণ মামলা পরিচালনার জন্য যে আইনজীবী প্যানেল রয়েছে, সেই প্যানেলে ভালো মানের আইনজীবী নেই বললেই চলে। এছাড়াও যেসব আইনজীবী রয়েছেন তারা বেশিরভাগ মামলা প্রতি খরচ নিয়ে আদালতে কাজ করেন। অল্প কিছু অইনজীবী রয়েছেন যারা ফুলটাইম ও বেতনভুক্ত হিসেবে কাজ করেন।"
এছাড়াও দুদকের মামলার বিচার হয় বিশেষ জজ আদালতে। যেসব আদালতেও বিচারক ও জনবলের ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, "দুদকের মামলা নিষ্পত্তির হার কম বলা যাবে না। অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তির তুলনায় দুদকের মামলা বেশ নিষ্পত্তি হচ্ছে। তবে হাইকোর্টে রিট বা রিভিশন দায়ের করে অনেক দুর্নীতিবাজ মামলার বিচার স্থগিতাদেশ নিচ্ছে। এটিই মূলত বিচারিক আদালতে মামলা নিষ্পত্তির জন্য বড় বাধা।"
দুদক সূত্রে জানা যায়, ৪৩৬ টি মামলারে বিচার হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
বড় মামলার নিষ্পত্তির হার কম
সোনালি ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় হলমার্কের বিরুদ্ধে আলোচিত ১১ মামলার একটিরও বিচার গত ৮ বছরে নিষ্পত্তি হয়নি। দুদকের আইনজীবীরা জানান, ২০১৮ সালে এসব মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে দুই দফা নির্দেশনা দিলেও তা কাজে আসেনি।
টেরিটাওয়েল (তোয়ালে জাতীয় পণ্য) উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ গ্রুপের প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি, মানিলন্ডারিং ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদুকের করা ১২ মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ২০১৪ সাল থেকে এসব মামলার বিচার এখন পর্যন্ত চলমান।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে থাকা গত ১০ বছরে দুদকের নিষ্পত্তি হওয়ার মামলার তালিকায় দেখা যায়, গত বিএনপি আমলের কৃষিবিদ জাবেদ ইকবালের বিরুদ্ধে একটি প্রকল্পের ৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলাটি ২০১৬ সালে বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে।
গ্রাহকের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে পাচারের অভিযোগে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ইউনিপে টু ইউ এর কর্তব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে রায় হলেও হাইকোর্টে আপিল অপেক্ষমান রয়েছে।
কিন্তু বহুল আলোচিত এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনির বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ থেকে ৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের মামলাও ২০১২ সাল থেকেই বিচার চলমান।
দুদকের পরিসংখ্যন থেকে জানা যায় ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৩৭৫ টি মামলা নিষ্পত্তি হলেও, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত মামলা নিষ্পত্তির হার একেবারেই কম।
২০১৬ সালে দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দাবী করেছেন, ৫ বছরে দায়িত্ব পালনকালে বেশি পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "ওই ৫ বছর চেষ্টা করেছি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য। এজন্য প্রসিকিউশন টিম ঢেলে সাজানো হয়েছে, তদন্তের গতি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেগুলো বর্তমান চেয়ারম্যান বাস্তবায়ন করলে আরও গতি বাড়বে।"
তদন্তে আটকা মামলা
বহুল আলোচিত সোনালি ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মামলার তদন্ত গত সাত বছর ধরেই তদন্ত চলছে। এ নিয়ে কয়েকদফা হাইকোর্টও উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তদন্তে গতি নেই।
ঋণের নামে জনতা ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ । এর মধ্যে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই চক্রের মূল হোতা ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদের ও তার ভাই জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ।
এই ঘটনায় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর চকবাজার থানায় চারটি মামলা করে দুদক। ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদের ও তার ভাই জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজসহ ১৫জনকে আসামী করে এসব মামলা করা হয়। এসব মামলার একটিতেও এখন পর্যন্ত অভিযেগপত্র (চার্জশিট) দিতে পারেনি দুদক।
মেসার্স সোনালী সোডা ফ্যাক্টরি ২০০০ সালের ২৭ জুন থেকে ২০০৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাঁচামাল আমদানি করে মূসক রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে সাবান উৎপাদন করে আবার মূসক পরিশোধ না করেই পণ্য খালাস করে ১৪ কোটি ২৬ লাখ ৯৯ হাজার ৩২৭ টাকা আত্মসাত করেছিল। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নুর উদ্দিন, কাস্টম এক্সসাইজ ও ভ্যাট, তেজগাঁও সার্কেলের তত্কালীন সুপারিনটেনডেন্ট মো. সিরাজুল হক ও আবুল খায়েরসহ ৯ কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজশে ওই অর্থ আত্মসাত করেন।
এই অভিযোগে তত্কালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর টাস্কফোর্স-৪ এর পরিদর্শক মোনায়েম হোসেন ২০০৪ সালের ১১ জুলাই তেজগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন। ১৫ বছর ধরে ঝুলে আছে এই মামলার তদন্ত। দীর্ঘদিন তদন্ত না সম্পন্ন না হওয়ায় ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে হাইকোর্টে রিট করে তদন্ত কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ নেয় আসামীরা।
দুদক সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮০০ মামলার তদন্ত চলমান। এসব মামলার বিপরীতে, আত্মসাত, পাচার ও জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা জড়িত।
তদন্ত ও বিচারে আইনের সময়সীমা কার্যকরের তাগিদ
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, দুদক আইন-২০০৪ এর ২০ ধারা অনুযায়ী ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্নের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও মামলার বিচার ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করার যে বিধান সেটিও বাস্তবায়ন করতে হবে।
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, "নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মামলা নিষ্পত্তিতে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে তা সমাধানের দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়াও হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ বেঞ্চ করা সময়ের দাবি।"
এছাড়াও দুদকের মামলায় চার্জশিট হওয়ার পর বিচারকাজ শুরু করতে অনেক বিলম্ব হয়, এ সমস্যা নিরাসনে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।