আসন্ন বাজেটে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ৫ শতাংশ করপোরেট করছাড়
আসন্ন বাজেটে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ভিত্তিতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট করছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত এই সম্প্রদায়কে নিয়োগ দানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ এই সুবিধা লাভ করবে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা। কর অব্যাহতির সুবিধা পেতে হলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর অন্তত ১০০ জন সদস্যের এক বছরের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে বসবাসকারী বৈষম্যের শিকার তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাবে পরিবর্তন আনতে তাদের মূলধারায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই প্রস্তাব উত্থাপন করে।
বর্তমানে, হিজড়া গোষ্ঠীকে নিয়োগদানের বিপরীতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা নেই।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কর্মস্থলে নিয়োগদানের শর্তে করছাড় সংক্রান্ত সরকারি পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন উদ্যোক্তা, সমাজতত্ত্ববিদ এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ।
নতুন এই উদ্যোগ সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য বিদ্যমান সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সাহায্য করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের (আইডিএমভিএস) অধ্যাপক খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিবর্তে নিয়োগদাতাদের উদ্দীপনার ব্যবস্থা করা নিঃসন্দেহে চমৎকার একটি উদ্যোগ।
সাধারণভাবে হিজড়া জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজে উপেক্ষিত। বৈষম্যের শিকার এই গোষ্ঠীকে সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তকরণের নিশ্চয়তা প্রদানে এই পদক্ষেপ সাহায্য করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, "আর্থসামাজিকভাবে কেউ পিছিয়ে পড়লে, তাদের সামাজিক স্বীকৃতি থাকে না।"
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর নেতা এবং বন্ধু সমাজকল্যাণ সংস্থার কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমানে পোশাক এবং ফ্যাশন শিল্পখাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ট্রান্সজেন্ডার অপারেটর, মার্চেন্ডাইজারসহ অন্যান্য পদে কাজ করছেন। অনেকে চামড়া শিল্পের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। এর বাইরে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবেও অনেকে কাজ করে আসছেন। বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সাথেও সম্পৃক্ত আছেন অনেকেই।
পাশাপাশি, এই গোষ্ঠীর বেশকিছু সদস্য উদ্যোক্তায় রূপান্তরিত হয়েছেন। খাবারের দোকানসহ বিউটি পার্লারগুলোতেও অনেক কাজ করেন।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে কাজ করছেন দুইজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। এদের মধ্যে তাসনুভা আনান শিশির বাংলাদেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার উপস্থাপক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প কারখানায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থার সৃষ্টির অন্যতম একজন পথিকৃৎ হলেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শিল্পাঞ্চলের ডেনিম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন।
মোস্তাফিজ বলেন, "সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে গৃহীত এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা অন্যদের জন্যও দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ সৃষ্টি করেছি।"
"তবে আমার জন্য বিষয়টি সহজ কাজ ছিল না। আমরা ১৫ জনকে নিয়োগের পরিকল্পনা করলেও পোশাক কারখানায় কাজ করতে আগ্রহী মাত্র নয়জনের সন্ধান পাই," বলেন তিনি।
সমাজের প্রতি সকল উদ্যোক্তার সমান দায়বদ্ধতা আছে। কেউ এই উদ্যোগ হাতে তুলে নিলে তাদের অবশ্যই পুরষ্কৃত করা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সামাজিক মূলধারাকরণে অবদান রাখায় মোস্তাফিজ উদ্দীন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে স্বীকৃতি লাভ করেন।
"ট্রান্সজেন্ডাররা অন্য মানুষদের মতো নন। তাদের মূলধারাকরণের জন্য বাড়তি নজরদারির প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে অন্যান্য কর্মীদেরও কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন আছে," বলেন তিনি।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত বৃহন্নলা সদস্য সুমি বলেন, "একটা পরিচয় এবং ভালো কর্মসংস্থান থাকায় নিজেকে নিয়ে আমি ভীষণ গর্বিত।"
ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর অপর সদস্য রোজ ফ্রান্সভিত্তিক ক্রয় প্রতিষ্ঠান ফ্যাশন-থিওরি লিমিটেডের অধীনে জে প্রজেক্টসে সহকারী মার্চেন্ডাইজার হিসেবে গত দুই বছর ধরে কাজ করে আসছেন।
প্রতিষ্ঠানটি তিনজন ট্রান্সজেন্ডারকে নিয়োগ প্রদান করেছে উল্লেখ করে রোজ বলেন, "আমার দায়িত্ব হলো আটটি গার্মেন্টস কারখানা থেকে সরবরাহ নিশ্চিত করা।
ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে বিষয়টি আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং। আমি মার্চেন্ডাইজিং ব্যবস্থায় শীর্ষ পদে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখি। বিষয়টি সত্যি হলে আমার সম্প্রদায়ের জন্য তা অনুকরণীয় হবে।"
ঢাকায় আশুলিয়া, সাভার এবং বাড্ডা এলাকায় বিউটি পার্লার ও ফাস্ট ফুড খাবারের দোকান স্থাপনের মাধ্যমে বহু ট্রান্সজেন্ডার সদস্য উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।
ট্রান্সজেন্ডার উদ্যোক্তা শাম্মি আশুলিয়ায় তার দুই পার্লারে নিজ সম্পদায়ের পাঁচজনকে কাজের সুযোগ দিয়েছেন।
তবে, সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়া বেশ কঠিন বলে মন্তব্য করেন শাম্মি। প্রথম দিকে তাদের কাছ থেকে সেবা গ্রহণে মানুষ দ্বিধা বোধ করলেও ধীরে ধীরে তাদের পরিষেবা স্বীকৃতি লাভ করে।
ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের জন্য সরকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগকেও স্বাগত জানান তিনি।
শাম্মি বলেন, "যথাযথ শিক্ষা গ্রহণে ট্রান্সজেন্ডাররা পিছিয়ে থাকায় নিয়োগকারীরা শিক্ষার বদলে আমাদের ইচ্ছাশক্তি এবং দক্ষতাকে প্রাধান্য দিবে বলে আমি মনে করি।"
"সরকার আমাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করলে আমদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলেই প্রতীয়মান হয়। যার অর্থ দাঁড়ায় সমাজে আমাদের থেকে উঁচু শ্রেণির নাগরিক আছে- শব্দটি হওয়া উচিত ট্রান্সজেন্ডার," বলেন বৈশাখী টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপক তাসনুভা আনান শিশির। সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করলেও তিনি এই সম্প্রদায়ের জন্য কিছু সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হত বলে মন্তব্য করেন।
সরকারি দপ্তরগুলোতে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, দপ্তর সহকারী এবং কম্পিউটার অপারেটরের মতো পদ আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সরকারি এই চাকরিগুলোয় তাদের নিয়োগদানের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী শিশির আরও বলেন, "তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মূলধারায় নিয়ে আসতে, সচেতনতা তৈরির জন্য মানুষের মধ্যে আরও সংবেদনশীলতার প্রয়োজন।"
১৯৯৬ সাল থেকে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বন্ধু সোশাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে বলেন, "ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়কে সমাজের মূলধারার অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে বিষয়টি একটি মাইলফলক হবে।"
ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়োগের পরিবর্তে সরকার করছাড় দিলে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি।
২০১৩ সালে সরকার এই সম্প্রদায়কে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।