অর্ধ-শতক পর বিলুপ্ত চিতা আবারও ফিরছে ভারতে
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী নভেম্বরের মধ্যেই সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৮,৪০৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আটটি চিতা ভারতে নিজেদের নতুন ডেরা খুঁজে নিতে যাচ্ছে। এদের মধ্যে ৫টি চিতা থাকবে পুরুষ এবং ৩টি মাদি। ভারতের জাতীয় পার্কেই হবে তাদের নতুন বসতি।
ভারতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রায় অর্ধ-শতকেরও বেশি সময় পর পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম স্থলচর প্রাণীটি আবারও দেশটিতে ফিরে আসতে যাচ্ছে।
ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটের ডীন ড. যাদবেন্দ্র দেব ঝালা জানিয়েছেন, অবশেষে তাদের কাছে বিড়াল গোত্রের প্রাণী চিতাকে পুনর্বাসনের মতো পর্যাপ্ত সম্পদ ও বাস্তুসংস্থান রয়েছে। তিনি আরো জানিয়েছেন যে, বিশ্বের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো মাংসাশী প্রাণীকে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে বসতি স্থাপনের জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে।
গায়ে কালো বুটি বুটি দাগ এবং অশ্রু বিন্দুর মতো চিহ্নের প্রাণী চিতা একটি শান্ত প্রাণী। কিন্তু তাদের অবিশ্বাস্য গতিই তাদের বিখ্যাত করে তুলেছে। শিকার ধরতে চিতা ঘন্টায় (১১২ কি.মি) ৭০ মাইল বেগে দৌড়াতে পারে। শিকার ধরার সময় নিপুণ লাফ দেয়ার জন্যও খ্যাতি আছে প্রাণীটির।
বিশ্বে টিকে থাকা ৭০০০ চিতার অধিকাংশই পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও বতসোয়ানা অঞ্চলে। ভারতে এই প্রাণীটিকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছে ১৯৬৭-৬৮ সালে। কিন্তু, ১৯ শতকের শেষ নাগাদ তাদের সংখ্যা ব্যাপকহারে কমতে থাকে।
ড. ঝালা জানান, চিতাগুলোর থাকার জন্য একটি জাতীয় পার্ক এবং মধ্য প্রদেশ ও রাজস্থানের দুটি অভয়ারণ্যকে নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রথম ৮টি চিতা জায়গা পাবে মধ্য প্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যানে, যেখানে তাদের শিকারের জন্য প্রচুর অ্যান্টিলোপ (এক ধরনের হরিণ) ও বুনো শূকর রয়েছে । বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা রাজস্থানের মুকুন্দ্র পাহাড়ে একটি বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্যও তোড়জোড় চালাচ্ছেন।
ভারতে চিতার ইতিহাস:
ভারতে আটক অবস্থায় প্রথম চিতার প্রজনন হয়েছিল ১৬ শতকে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে। তার বাবা আকবরের শাসনকালে মোট ১০,০০০ চিতা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আকবরের দরবারেই ছিল ১০০০টি চিতা।
২০ শতকে চিতাকে ক্রীড়া ও শিকারে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আনা হতো। ১৭৯৯ ও ১৯৬৮ সালের মধ্যে অন্তত ২৩০টি চিতা এ অঞ্চলে থাকার কথা জানা গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে চিতাই একমাত্র বড় স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
চিতা শিকার করা, আবাসভূমির সঙ্কোচন ও পর্যাপ্ত শিকার না থাকা ইত্যাদি কারণেই ভারতে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে চিতারা প্রায়ই গ্রামে ঢুকে পড়তো বলে তাদের শিকার করে নির্মূল করা হতো।
১৯৫০ সাল থেকেই ভারত চিতাকে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলো। ১৯৭০ এর দশকে ইরান থেকে চিতা আনার কথা থাকলেও, ইরানের শাহ পদচ্যুত হওয়ার পর সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়।
চিতাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এনে বসতি স্থাপন করানোতে কিছু ঝুঁকি থাকলেও, এই ঘটনা পৃথিবীতে বিরল নয়। তাছাড়া, বিশেষজ্ঞদের মতে, চিতা অত্যন্ত অভিযোজনক্ষম প্রাণী। দক্ষিণ আফ্রিকার চিতা সংরক্ষণবাদী- ভ্যান ডার মারউই বলেন, 'যতক্ষণ পর্যন্ত চিতা তার পর্যাপ্ত শিকার পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এদের আবাস ধরে রাখা কঠিন কিছু না। তারা উচ্চ মাত্রার শিকারী পরিবেশে থাকতে পারে এবং সিংহ, হায়েনা বা বন্য কুকুরের সঙ্গে পাশাপাশি টিকে থাকতে পারে।'
তবে সমস্যা হচ্ছে, চিতা প্রায়ই শিকারের সন্ধানে মানুষের বাড়িঘর বা জমিতে ঢুকে পড়ে এবং তারা নিজেরাও অন্য শিকারী প্রাণীদের নিশানায় পরিণত হয় বেশি।
তবে ডা. ঝালার মতে, 'চিতা খুবই নাজুক প্রাণী। তারা গতিদানব এবং তারা ঝামেলা এড়িয়ে চলে।'
- সূত্র: বিবিসি