বিচারের ধীরগতিতে ৩৭৯টি অর্থ পাচার মামলায় আটকে গেছে ৩০০০ কোটি টাকা
অর্থ পাচারের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচার কাজে ব্যাপক ধীরগতি রয়েছে।
২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়নের পর এই আইনে দায়ের বিভিন্ন সময় হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ৩৭৯টি মামলা এখন পর্যন্ত বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা জড়িত।
সুপ্রিম কোর্ট ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা যায় ৩৮৯টি মামলার মধ্যে হাইকোর্টের আদেশে ৪১টি মামলার বিচারকাজ স্থগিত রয়েছে। এর মধ্যে ৭৩টি মামলা রয়েছে ৫ বছরের বেশী সময় ধরে বিচারাধীন।
৩৭৯টি মামলার মধ্যে ১৮৩টি দুদকের দায়ের করা অন্যগুলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), সিআইডি, শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়ের করা।
সুপ্রিম কোর্ট তার পরিসংখ্যানে বলেছে, ২০১৯ সালে মাত্র ১০টি ও গত বছর মাত্র ৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
দুদক তার পরিসংখ্যানে বলেছে, ২০১৯ সালে সংস্থাটি মামলা দায়ের করেছে ৭টি আর গত বছর দায়ের করেছে ১১টি মামলা।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচার চলছে বিশেষ জজ আদালতে। মামলা নিষ্পত্তির এই ধীরগতি নিয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অর্থমন্ত্রী পাচাকারীদের নামের তালিকা চেয়ে আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদে। অথচ চিহ্নিত ও অভিযুক্ত পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর তদন্ত হয়ে সেই মামলার বিচার এখনো ঝুলে আছে বছরের পর বছর।
তিনি বলেন, অর্থপাচারকারীরা অনেক প্রভাবশালী হওয়ায় মামলাগুলোর বিচারেও তারা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়াও যখন কোনো উপায়ান্তর না পায় তখন হাইকোর্টে গিয়ে বিচারকাজের ওপর স্থগিতাদেশ নেয়। ফলে বছরের পর বছর এসব মামলা ঝুলে আছে।
এছাড়াও যেসব আদালতে এসব মামলার বিচার হয়, অভিযোগপত্র দায়েরের পর দীর্ঘদিন সেই মামলা থাকে বিচার শুরুর অপেক্ষায়। আবার এসব মামলা তদন্তেও বেশ ধীরগতি।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান টিবিএসকে বলেন, এসব মামলা পরিচালনার জন্য দুদকের আইনজীবী প্যানেল রয়েছে তারা যথাযথ কাজ করছেন এবং দ্রুত বিচার শেষ হওয়ার জন্যও তারা তৎপর। কিন্তু কিছু মামলা হাইকোর্ট আপিল বিভাগে ঝুলে থাকায় সেগুলোর বিচার শুরু হচ্ছে না। আদালতের এই বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কাজ করছে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে দেশের অর্থ দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা জরুরি। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কয়েক বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বিচারিক আদালতের প্রতি যে নির্দেশনা রয়েছে তা মেনে চলতে বিচারকদের আহ্বান জানান সাবেক এই প্রধান বিচারপতি ।
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেন, বিশেষ জজ আদালতে এসব মামলার বিচার হয়। কিন্তু দেশে বিশেষ আদালত রয়েছে চাহিদার চেয়ে অনেক কম। আবার এসব আদালতে অর্থপাচারের মামলা ছাড়াও আরও বিভিন্ন মামলার বিচার হয়। এছাড়াও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে যে পরিমাণ জনবল, অবকাঠামো দরকার তা যথেষ্ট নয়। ফলে এসব মামলার বিচারকাজ চলে খুবই ধীরগতিতে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক টিবিএসকে বলেন, অর্থপাচারকারীদের খুজে বের করার দায়িত্ব দুদকসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার ওপর। তারা কাজ করছে। আদালতের কাজ বিচার সম্পন্ন করা, সেটিই হচ্ছে। করোনার কারণে গত বছর অন্যান্য মামলার মতো অর্থপাচারের মামলারও বিচারে ধীরগতি দেখা দিয়েছ।
তিনি বলেন, এখন আদালতগুলো বেশীরভাগ ভার্চুয়ালি চলছে। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনে নতুন করে নির্দেশনা জারি করা হবে।
অর্থ পাচারের মামলা কম কেন
গত বছরের মার্চ মাসে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে সাত বছরে ৫ হাজার ২৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে বিদেশে। এ অর্থ পাচারের অধিকাংশই হয়েছে আমদানি-রপ্তানিতে জালিয়াতির মাধ্যমে।
সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম টিবিএসকে বলেন, জিএফআই এর গবেষণা আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করে সম্পন্ন করা। তাদের তথ্য সঠিক। তবে তারা শুধু আমদানি-রপ্তানিতে হিসেবের গড়মিল তুলে ধরে গবেষণাটি করেছে।
বাণিজ্য নির্ভর ছাড়াও আরো বেশ কিছু উপায়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। যে বিষয়গুলো ওই গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসেনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্ব এসব পাচারকারীদের খুঁজে বের করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান টিবিএসকে বলেন, আইন অনুযায়ী মামলা করবে দুদকসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থা।
তারা কোনো অনুসন্ধান বা তদন্ত করলে সেখানে বিএফআইইউ তাদেরকে সহায়তা করবে।
দুদক সচিব ড. মু: আনোয়ার হোসেন হাওলাদার টিবিএসকে বলেন, দুদকের কাছে কোনো অভিযোগ করলে বা দুদক কোনো তথ্য পেলে সেটি অনুসন্ধান করে এরপর মামলা করে। দুদকের কাছে যেসব অভিযোগ এসছে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিক খবরে পাওয়া অর্থ পাচারকারীদের নাম অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে দুদক।
তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের এখতিয়ার ও সক্ষমতা অনুযায়ী যথাযথভাবে কাজ করছি।'
গত বছরের ১৮ অক্টোবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন রাজধানীতে এক মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বলেন, রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা। তিনি বলেন, গোপনে কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে।
'আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ২২ অক্টোবর হাইকোর্ট স্ব-প্রণোদিত হয়ে দুদক, এনবিআর ও বিএফআইইউসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অর্থপাচারকারীদের নাম-পরিচয়সহ যাবতীয় তথ্য চায়।
পরবর্তীতে বিএফআইইউ তেমন কোনো তথ্য না দিলেও দুদক, এনবিআর তাদের দায়ের করা মামলার তথ্য আদালতে উপস্থাপন করে। দুদক বলে ১৮৩টি মামলা রয়েছে বিচারাধীন। যার সাথে ১১০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ পাচারের অর্থ জড়িত।
বিএফআইইউ এর তথ্য না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, এগমন্ট চুক্তি অনুযায়ী বিএফআইইউ কারও নাম প্রকাশ করতে পারে না। শুধু তদন্তের কাজে তাদের তথ্য ব্যবহার করা যায়। তবে বিভিন্ন বিদেশি বাংলাদেশি মিশনগুলোতে বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ও এই অর্থ দিয়ে কেনা সম্পত্তির বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অল্প দিনের মধ্যে এই তথ্যগুলো পেলে আদালতে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
তবে গত মার্চ মাসে আদালতে দেওয়া এক প্রতিবেদনে ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট বলেছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ অর্থবছরে দুদক, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ ও এনবিআরকে ৩২২৮টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন দিয়েছে।