নতুন প্রযুক্তি ও নীতিমালায় দিনবদলের সূচনা বৈশ্বিক এভিয়েশন শিল্পে
১৯০৩ সালে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রথম আকাশে ওড়া থেকে শব্দের চাইতেও বেশি গতির উড়োজাহাজের উন্নয়ন; এভিয়েশন শিল্পের অগ্রগতিকে বরাবর চালিত করেছে প্রযুক্তির বিকাশ ও মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ২১ শতকে পা রেখে এই খাত আবারও নতুনতর উদ্ভাবন ও বৈপ্লবিক ডিজাইন তৈরির অসীম আগ্রহ তুলে ধরছে।
যেমন; গত সেপ্টেম্বরে যাত্রীবহনে সক্ষম একটি হাইড্রোজেন জ্বালানি কোষ (ফুয়েল সেল) চালিত উড়োজাহাজ প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের আকাশে পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করে। একইমাসে, এয়ারবাস প্রকাশ করে তিন স্তরের হাইড্রোজেন জ্বালানি চালিত একটি পরিকল্পনাধীন কনসেপ্ট বিমানের বিস্তারিত তথ্য। শুধু ধ্যানধারণার পর্যায়ে নয় এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ ওই মডেলের বিমান সার্ভিসে যুক্ত হবে বলেও দাবি ইউরোপের এভিয়েশন জায়ান্টটির।
যাত্রীবাহী বিমানকে আবারো সুপারসনিক যুগে ফেরানোর প্রয়াসও পেয়েছে বাস্তব অগ্রগতি। চলতি মাসেই বুম সুপারসনিক নামের একটি কোম্পানির সঙ্গে শব্দগতির ১.৭ গুণ বেশি দ্রুতগতির ১৫টি বিমান ক্রয়ের বাণিজ্যিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ যাত্রীবাহী সংস্থা- ইউনাইটেড এয়ারলাইনস।
চুক্তির পর এক বিবৃতিতে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ জানান, 'ওভারচিউর' নামের নির্মাণাধীন বিমানটি 'শতভাগ টেকসই ও পরিবেশ সম্মত জ্বালানি ব্যবহার করবে।'
আলোচিত সব কয়টি প্রচেষ্টাই আসলে পরিবেশে এভিয়েশন শিল্পের নেতিবাচক প্রভাব সীমিত করতে প্রযুক্তিকে নতুন রূপদানের উদ্যোগ। মহামারিতে পৃথিবীজুড়ে ফ্লাইট চলাচল অনেকাংশে কমলেও, সামগ্রিক শিল্পটির দূষণ কমানো সত্যিকার অর্থে অনেক বড় মাত্রার চ্যালেঞ্জ।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) বলছে, এভিয়েশন থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ 'গত দুই দশকে বিপুল হারে বেড়েছে।' ২০১৯ সালে নিঃসরণ ১ গিগাটন বা শত কোটি মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। এই বৃদ্ধি বৈশ্বিকভাবে পোড়ানো মোট জীবাশ্ম জ্বালানির ২.৮ শতাংশ থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের সমান বলে উল্লেখ করে সংস্থাটি।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড 'বাণিজ্যিক এভিয়েশনকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা অন্যতম ও ক্রমবর্ধমান এক উৎস' বলে অবিহিত করে। 'আকাশপথের ভ্রমণের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী কার্বন ফুটপ্রিন্ট তৈরি করেন' বলেও সেখানে মন্তব্য করে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করা সংস্থাটি।
সমাধানে বহুবিধ উপায়:
জলবায়ু পরিবর্তন রূপ নিয়েছে বাস্তব সমস্যায়। পৃথিবীর নানান প্রান্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘন ঘন হানা দেওয়া ও তাপমাত্রার পরিবর্তন তুলে ধরছে সঙ্কটের ভয়াবহতা। এই অবস্থায় জোর দাবি উঠেছে নিঃসরণের উৎস সীমিতকরণের। এভিয়েশন শিল্প সংশ্লিষ্টরাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসি'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের ক্রেনফিল্ড ইউনিভার্সিটির অ্যারোস্পেস বিভাগের পরিচালক লেইন গ্রে শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য অর্জনকে এভিয়েশন শিল্পের প্রধান গুরুত্বের বিষয় বলে উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে, তিনি চ্যালেঞ্জটি মোকাবিলায় নানাবিধ সমাধানের উপায় তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
"বিমানের চালিকাশক্তি বা প্রপালশন সিস্টেম তৈরি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মূল উৎসে রূপ নিয়েছে। তবে একইসঙ্গে, জ্বালানি ব্যবহার কমাতে বিমানের নানা অংশ তৈরিতে হালকা ধরনের উপাদান যেমন; কার্বন কম্পোজিটের ব্যবহার বৃদ্ধির দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে, সঙ্গে নতুন উড্ডয়ন পদ্ধতির গবেষণাও বন্ধ রাখা যাবে না।"
বিষয়টির আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "বিমানের কাঠামো ও যন্ত্রপাতির ওজন বেশি হলে জ্বালানি ব্যবহার বাড়ে। তাই উড়োজাহাজ উৎপাদকেরা সবসময় ওজন কমানোর চেষ্টা করেন। তাছাড়া, বিমান বন্দরে অবতরণের আগেও একটি উড়োজাহাজকে ক্ষেত্রবিশেষে আধাঘণ্টা সময় চক্কর দিতে হয়। এয়ার ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও এখানে জ্বালানি ব্যবহার ও দূষণ কমানোর সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই বিমানবন্দরগুলোয় আকাশপথ ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও প্রয়োগের কথাও এখন শোনা যাচ্ছে।"
হাইড্রোজেন জ্বালানি কোষ তৈরির পাশাপাশি বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত বিমান তৈরি নিয়েও সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনা শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই, ভোলোকপ্টার ও লিলিয়াম নামের দুটি কোম্পানি রানওয়ে ব্যবহার ছাড়াই সরাসরি উপরদিকে উড্ডয়ন বা উপর থেকে নিচে অবতরণ করতে সক্ষম ভার্টিক্যাল উড়োজাহাজ নির্মাণের গবেষণা করছে।
তবে এধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার যাত্রার ধরনের ওপর নির্ভর করবে। উড়োজাহাজ আকারে ছোট হলে বা যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত হলে সহজেই এটি প্রয়োগ করা যাবে বলে জানান ক্রেনফিল্ড ইউনিভার্সিটির লেইন গ্রে।
তিনি বলেন, "বর্তমানের হাইড্রোজেন জ্বালানি কোষ ও ব্যাটারির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেগুলো খুব ছোট আকারের বিমানে ব্যবহারের লক্ষ্য নিয়ে উদ্ভাবিত। এধরনের বিমানের পাল্লা হাজার কিলোমিটারের বেশি হবে না।"
"পরবর্তী পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তাই হাজার কিলোমিটারের চাইতে বেশি এবং ন্যূনতম ৩ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে সক্ষম কার্বন শূন্য বিমান তৈরির দিকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। বাণিজ্যিক লাভ নিশ্চিতের পাশপাশি পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে যার বিকল্প নেই।"
- সূত্র: সিএনবিসি