৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বেনাপোল-পেট্রাপোল রেলপথ সংস্কারের কাজ শুরু
করোনাকালীন সময়ে রেলপথে আমদানি বাণিজ্যের চাহিদা বাড়ায় চলতি মাসে অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ শুরু করেছে রেল বিভাগ। বেনাপোল রেলস্টেশন থেকে ভারতের পেট্রাপোল বন্দর পর্যন্ত রেল সড়কে চলছে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার ও ডাবল রেললাইন স্থাপনের কাজ। রেলপথে আমদানির চাহিদা বাড়লেও ব্রিটিশ আমলের সংকীর্ণ আর জরাজীর্ণ রেলপথে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেলের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি কন্টেইনার টার্মিনাল স্থাপন হলে ভারতের সাথে আমদানি বাণিজ্য যেমন বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে তেমনি বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি কমবে।
রেল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে বাংলাদেশের ১২টি বন্দর দিয়ে রেল ও স্থলপথে আমদানি, রপ্তানি বাণিজ্য হয়ে থাকে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে একমাত্র বেনাপোল বন্দর দিয়েই স্থল এবং রেলপথে আমদানি বাণিজ্য ও পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত হয়। ফলে এ বন্দরের গুরুত্ব অন্যান্য বন্দরের চাইতে বেশি। সড়কপথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও ব্রিটিশ আমলে স্থাপন হয় এ রেলপথ। দেশভাগের পর বন্ধ হয়ে যায় রেলের কার্যক্রম।
পরবর্তীতে ২০০০ সালে পুরানো অবকাঠামোয় আবার রেলে শুরু হয় আমদানি। তবে ফ্লাইঅ্যাশ আর জিপসাম জাতীয় পণ্য আমদানির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বাণিজ্য। গত বছর করোনার শুরুতে সংক্রমণ রোধে ভারত সরকার স্থলপথে বেনাপোল বন্দর দিয়ে তিন মাস আমদানি, রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ রাখে। এতে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়। সরকারও বঞ্চিত হয় বিপুল পরিমাণের রাজস্ব থেকে। পরে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে রেলপথে সব ধরনের পণ্য আমদানি শুরু হয়।
কিন্তু ব্রিটিশ আমলের জরাজীর্ণ-সংকীর্ণ রেলপথে নানান প্রতিবন্ধকতায় চাহিদা মত পণ্য আমদানি বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছিল। একটি কার্গো রেল বন্দরে প্রবেশ করলে জায়গার অভাবে আর একটি কার্গো রেল ভারত থেকে প্রবেশ করতে পারতো না। বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীরা সরকারের বিভিন্ন মহলে চাপ প্রয়োগ করলে অবশেষে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলের অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ শুরু হয়। আগামী তিন মাসে নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
বন্দরবাসী শাহিনুর রহমান ও সোহাগ হোসেন জানান, ব্রিটিশ আমলের রেল লাইনে বাণিজ্য ও যাত্রী পরিবহন অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। রেল সংস্কার হওয়ায় এলাকাবাসী খুশি। তবে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ওপর দিয়ে যাওয়া রেলপথে নিরাপদ যাতায়াতের জন্য রেল ক্রসিং নির্মাণ দরকার।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, চট্টগাম বন্দরের পর বেনাপোল বন্দরের অবস্থান। কদিন পর পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে। বেনাপোলে বন্দরে রেলপথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কন্টেইনার টার্মিনাল চালু হলে ভারতের সাথে আমদানি, রপ্তানি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া যেহেতু রেলপথে সব ধরনের পণ্য বহনের সুযোগ রয়েছে তাই করোনা পরিস্থিতিতে সংক্রমণ রোধে ব্যবসায়ীদের রেলপথে বেশি বেশি পণ্য পরিবহনের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বলেন, 'বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে রেলে বাণিজ্য যেমন অনেকটা নিরাপদ তেমনি সাশ্রয়ী। উন্নয়ন কাজ শেষ হলে রেলপথে রপ্তানি চালুর পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে'।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রপ্তানি সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক জানান, 'করোনার কারণে গত বছরে ব্যবসায়ীরা ভারতের পেট্রাপোলে কালিতলা ট্রাক পার্কিং সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল। রেলপথে সব ধরনের পণ্যে আমদানি শুরু হওয়ায় সে জিম্মি দশা থেকে অনেকটা মুক্তি পেয়েছে। রেলের পরিধি বিস্তার হলে বাণিজ্য আরো প্র্রসারিত হবে'।
যশোর রেল বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী অলিউল হক বলেন, 'প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বেনাপোল রেল স্টেশন থেকে শুরু করে পেট্রাপোল বন্দর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পুরনো ব্রডগেজ রেল লাইন সংস্কার ও বেনাপোল বন্দরের দুই পাশে পণ্যবাহী কার্গো রেল দাঁড়ানোর জন্য দুটি অতিরিক্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ চলছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এসব উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হবে'।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, 'আমরা অনেক আগে থেকে বেনাপোল ও নওয়াপাড়া এলাকায় কন্টেইনার টার্মিনাল স্থাপনের জন্য দাবি করে আসছি। বেনাপোলে রেলপথ সম্প্রসারিত হলে বাণিজ্য বাড়বে। সেই সাথে ব্যবসায়ীদের খরচও কম হবে'।
বেনাপোল রেল স্টেশন মাস্টার সাইদুর রহমান বলেন, 'জরাজীর্ণ রেলপথে বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ায় সরকার সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। পর্যাপ্ত ইয়ার্ড না থাকায় একটি কার্গো রেল বন্দরে প্রবেশ করলে আর একটি ভারত থেকে আসতে পারতো না। এতে সময়মত পণ্য পরিবহন বিঘ্নিত হতো। উন্নয়ন কাজ শেষ হলে এ পথে বাণিজ্য যেমন বাড়বে, তেমনি রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। যানবাহন চলাচল ও এলাকাবাসীর নিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে রেল ক্রসিংয়ের আবেদন জানানো হয়েছে'।
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের গত এক মাসে (মে) বেনাপোল বন্দরের রেলপথে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার ৭৬৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। এ সময় আমদানি পণ্যের শুল্ককর বাদে শুধু রেলের ভাড়া বাবদই সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।