করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের হাতছানি, আমরা কতটা প্রস্তুত?
ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে সংক্রমণ পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ঢাকায়ও সংক্রমণ বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৮২ জন, যা ৫২দিনে সর্বোচ্চ। এমন পরিস্থিতিতে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এখনই রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা ও সংক্রমণ চেইন বন্ধের জন্য যথাযথ প্রস্তুতির তাগিদ তাদের। প্রস্তুতি আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিও।
রোববার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের উপস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি'র ৯ম বৈঠকে টেস্ট কিট কেনা, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় আইসিউ ও অক্সিজেন এর বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাব্য সংকট থেকে উত্তরণ বিষয়ক আলোচনা হয়।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি'র সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে সীমান্তে সংক্রমণ বাড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে সারাদেশের পরিস্থিতি আবারও খারাপ হতে পারে। তার আগেই সব প্রস্তুতি নিতে হবে। করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভে হাসপাতালে বেড সংকট দেখা দিয়েছিলো, তাই আবার যেনো সেই সংকট শুরু না হয় সেজন্য আমরা এখনি প্রন্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছি।"
তিনি বলেন, "এখনো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপন করা হয়নি। আমরা দ্রুত আইসিইউ স্থাপনের তাগিদ দিয়েছি। এখন দুটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন উৎপাদন করা হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে আরো তিনটি প্ল্যান্ট থেকে ২৫০ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদন করা হবে বলে কমিটিকে অবহিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দ্রুত অক্সিজেনের মজুদ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
মানুষকে সচেতন করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি,শিক্ষক, খেলোয়ার, ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে মাস্ক পরার প্রতি আগ্রহী করতে প্রচারণা চালানোর পরামর্শ দেয়া হয় বলেও জানান ডা. আব্দুল আজিজ।
এদিকে মারাত্মক সংক্রামক এই ভাইরাসটি গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে দেশের আরও ৩ হাজার ৬৪১ জনের দেহে। গত বুধবার আক্রান্ত হয়েছিল ৩ হাজার ৯৫৬ জনের যা গত ৭ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। মহামারি শুরুর পর থেকে সব মিলিয়ে এই শনাক্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৮ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৭ জনে। এ পর্যন্ত দেশে ১৩ হাজার ৫৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে কোভিডজনিত কারণে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ২২ হাজার ২৩১টি কোভিড পরীক্ষার বিপরীতে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে শতকরা ১৬ দশমিক ৩৮ জনের মধ্যে। গত শুক্রবার শনাক্তের হার ১৮.৫৯ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে, যা গত ৬১ দিনের মধ্যে একদিনে সর্বাধিক ছিল।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দেশে করোনা সংক্রমণের ফার্স্ট ওয়েভে দৈনিক শণাক্ত ৪ হাজারের বেশি ও পজিটিভিটি রেট ২০% বেশি ছিলো। এখন দৈনিক শণাক্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি হচ্ছে এবং পজিটিভিটি রেটও ১৮% ছাড়িয়েছে। তাই আরেকটি ওয়েভের হাতছানি দেখা দিচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দৈনিক রোগী ফার্স্ট ওয়েভের সমান হবে হবে ধারণা করা হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "এখনই সংক্রমণের ঢেউ দ্রুত নামিয়ে আনতে হবে তা না হলে ঈদে মানুষের মুভমেন্ট বেড়ে গেলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে। এখন দুই সপ্তাহের জন্য পুরো দেশে কঠোর লকডাউন দিতে হবে। আন্তজেলা মুভমেন্ট বন্ধ করতে হবে, শহরে সীমিত পরিসরে যানবাহন চলাচল করা, হোম অফিস দিতে হবে তা না হলে, হাসপাতালের ওপর চাপ বাড়বে, অক্সিজেন সংকট দেখা দিবে আবার সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়বে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, 'এপিডেমাইওলজিক্যাল উইক' বিবেচনায় ২৩তম সপ্তাহের (৬-১২ জুন) তুলনায় ২৪তম সপ্তাহে (১৩-১৯ জুন) রোগী শনাক্ত ৫৫.১৬% ও মৃত্যু ৪৬.৩০% বেড়েছে।
হাসপাতালে বেডের তুলনায় রোগী বেশি
খুলনায় মেডিকেল কলেজের কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্ধারিত বেড রয়েছে ৯০টি। রোববার সেখানে রোগী ভর্তি ছিলো ১১৮ জন। শুধু খুলনা মেডিকেল কলেজ নয়, যশোর জেনারেল হাসপাতাল,রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে রোববার বেডের তুলনায় রোগী বেশি ভর্তি ছিলো।
এছাড়া খুলনা বিভাগের দশটি হাসপাতালে আইসিইউ বেড রয়েছে মাত্র ৪০টি। এর মধ্যে চারটিতে কোন আইসিউ বেড নেই। সেসব রোগীরা খুলনা মেডিকেলে ভীড় জমায়।
শুধু ঢাকার বাইরে নয়, ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালেও বেডের তুলনায় বেশি রোগী ভর্তি থাকছে। রোববার কুর্মিটোলা হাসপাতালে ২৭৫ টি বেডের বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলো ২৭৮ জন। কুর্মিটোলাসহ ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড আরো তিনটি হাসপাতালের আইসিইউতে কোন বেড খালি নেই্।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সারাদেশে কোভিড রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড জেনারেল বেড রয়েছে ১২০৫৬টি এর মধ্যে ৮০৭৯টি বেড খালি রয়েছে। আইসিইউ বেড রয়েছে ১১৩৪টি ও খালি রয়েছে ৬৬১টি। হাই ফ্লো ণ্যাজাল ক্যালুনা রয়েছে ১৬০৩টি ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটসহ বেড রয়েছে ১৬১৯টি।
তবে কাগজে কলমে বেড খালি দেখালেও জেলাগুলো রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। রাজশাহী বিভাগে দশটি হাসপাতালে ২৫৭টি জেনারেল বেড ও ১৪টি আইসিইউ বেড খালি দেখালেও কোভিড রোগীদের চিকৎসার সুযোগ না থাকায় শুধু রাজশাহী মেডিকেলে চার জেলার রোগী সেবা নিচ্ছে। সেখানে বেডের তুলনায় ৬৮ জন বেশি রোগী মেঝেতে সেবা নিচ্ছে।
বর্তমানে দুটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে এখন দিনে ১৪০ মেট্রিক টন অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পিক এর সময় সর্বোচ্চ অক্সিজেন চাহিদা ছিল ২১০ টন পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসাইন মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন রয়েছে। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও অক্সিজেন লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে, তবে মানুষ সচেতন না হলে হাসপাতালের প্রস্তুতি বাড়ালেও পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে।"