৯০ বছর পর জার্মান সেনাবাহিনীতে প্রথম ইহুদি ধর্মগুরু নিয়োগ
জার্মানিতে কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়টায় ফেসবুকে লাইভ স্ট্রিমিং প্রার্থনা সেবার মাধ্যমে ইহুদি ধর্মগুরু জোয়ালত বালার বেশ ভালোসংখ্যক অনলাইন অনুসারী জুটেছিল।
এই মুহূর্তে যখন দেশটি তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে, তখন তিনি এমন এক পদে আসীন হতে যাচ্ছেন, যা একসময় ছিল অকল্পনীয়। জোয়ালত বালা জার্মান সেনাবাহিনীতে প্রধান ইহুদি পণ্ডিত হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। অ্যাডলফ হিটলার সশস্ত্র বাহিনীগুলো থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করার প্রায় ৯০ বছর পর এবারই প্রথম কোনো ইহুদিকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
৯ বছর বয়স পর্যন্ত বালা জানতেনই না তিনি ইহুদি; এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া একজনের সন্তান।
নাৎসি বাহিনীর হাতে ইহুদি গণহত্যার আট দশক পরে এসে একজন ইহুদি ধর্মগুরু গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন, এই দৃশ্য নিঃসন্দেহে ইহুদি জাতির জন্য এক গৌরবের মুহূর্ত।
পূর্ব জার্মানির লিপজিগের একটি উপাসনালয়ে আজ সোমবার শপথ গ্রহণ করবেন বালা। কর্তৃপক্ষ মনে করছেন, তার এই নিয়োগের মাধ্যমে বুন্দেসোয়ারের (আধুনিক জার্মান সেনাবাহিনী) বৈচিত্র্য ও উদার মনোভাব প্রকাশ পাবে।
অবশ্য বালার এই নিয়োগ যে খুব শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, তা নয়। এর দৃশ্যপটে আছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জার্মান সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ভেতরে চরমপন্থী ডানপন্থীদের নানা কেলেঙ্কারি এবং দেশটিতে ক্রমবর্ধমান ইহুদিবিদ্বেষ।
গত বছর সেনাবাহিনীর অভিজাত কমান্ড ফোর্স কেএসকে'র উচ্চপদস্থদের মধ্যে ডানপন্থী চরমপন্থার প্রমাণ পাওয়ায় তাদেরকে অব্যহতি দেওয়া হয়; যদিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যানেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাওয়ার গত মঙ্গলবার জানিয়েছেন, সংশোধিত ইউনিটই কাজ চালিয়ে যাবে।
অন্যদিকে, গত সপ্তাহেই আলাদা আরেকটি স্টেট পুলিশ ইউনিট এসইকে'কে অব্যহতি দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, অনলাইন চ্যাট গ্রুপে তারা নাৎসিদের গুণকীর্তন করেছে।
জার্মান সেনাবাহিনীতে চরমপন্থার প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়ে ৪২ বছর বয়সী বালা বলেন, 'আমার মনে হয় সবারই এই ইস্যু নিয়ে চিন্তা করা উচিত।'
লিপজিগে নিজ বাসস্থান থেকে ফোন কলে বালা সিএনএনকে বলেন, 'সেনাবাহিনীর ইহুদি পণ্ডিত যিনি হবেন, তিনি এক সপ্তাহেই সব সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারবেন না। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটা লক্ষ্য স্থির করে কাজ করতে হবে। এক দশক পর আমরা জার্মান সমাজ এবং বুন্দেসোয়ারকে কোন অবস্থানে দেখতে চাই, সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।'
এই মুহূর্তে বুন্দেসোয়ারে থাকা ৮০-৩০০ ইহুদি সৈনিকের জন্য যাজকসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করা ১০ জন র্যাবাই বা ইহুদি পণ্ডিতের একজন হবেন জোয়ালত বালা। তবে শুধুমাত্র সৈন্যদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রকাশ করা তথ্যের ভিত্তিতে ইহুদি সৈন্যের এই হিসাব পাওয়া গেছে।
অন্য সব খ্রিস্টীয় যাজকের মতো ইহুদি পণ্ডিত বা র্যাবাইরাও বিভিন্ন ধর্মীয় সেবা ও কাউন্সেলিং দিয়ে থাকেন, যা সব ধর্মের সৈন্যই চাইলে গ্রহণ করতে পারে। বর্তমানে বুন্দেসোয়ারে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট যাজক আছেন এবং সোমবার থেকে ইহুদি যাজকও তার যাত্রা শুরু করবেন।
শেষবার যখন ইহুদি পণ্ডিত বা যাজকেরা জার্মান সেনাবাহিনীর অংশ ছিলেন, সেটি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। তখন ১ লাখ ইহুদি সৈন্য দেশের জন্য লড়াই করেন। কিন্তু ১৯৩৩ সালে হিটলার নাৎসি বাহিনীর হয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইহুদিদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার মিশনে নামেন।
তবে বর্তমান জার্মানি 'এরিনেরুংস্কালচার' নামে 'স্মরণ করা'র একটি সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে স্কুলের শিশুরাও জানতে পারছে, ইহুদিদের ওপর জঘণ্য অত্যাচার ও গণহত্যা চালানো হয়েছিল।
বালা বলেন, 'ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিই সবচেয়ে খোলামেলাভাবে তাদের অতীতের সম্মুখীন হয়েছে এবং সেটি মোকাবিলা করেছে। এই প্রচেষ্টার কথা আমাদের মনে রাখতেই হবে। তবে তার মানে এই নয় যে, সবকিছু এখন ঠিকঠাক চলছে।'
ইহুদি মা ও অ-ইহুদি বাবার ঘরে বালার জন্ম হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে, ১৯৭৯ সালে। বালা মনে করেন, সবাই এক হয়ে কাজ করার মাধ্যমে দেশ থেকে উগ্রপন্থা বিদায় করা সম্ভব। তিনি বলেন, 'এখন জার্মানির ইহুদিরা অতীতের খারাপ কাজ নিয়ে শুধু চিৎকার করে চলে না, আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করতে চাই। ইহুদি সমাজ এখন বদলে গেছে। আমরা বুঝতে পারছি, জার্মানি আর আগের মতো নেই।'
-
সূত্র: সিএনএন