কফির ইতিহাস, কফির স্মৃতি
১.
স্বপ্নে মাঝে মাঝে সন্ধ্যাতারা আসে এখনো। গুলশান দুইয়ের কফিশপে আমরা সকাল সকাল একান্ত সময় কাটাতাম। সিঁড়িতে ওঠার সময় নিজেদের নিভৃতি খুঁজে নিতাম। আমাদের এই অনুসন্ধানে মিশে থাকতো কফির সুগন্ধ। সে আমাকে প্রায়ই বলতো, কফি খেতে তার অপরাধবোধ হয় কিন্তু বসুন্ধরা থেকে কাছাকাছি বসার কোনো ডিসেন্ট জায়গা নেই বলেই সে আমায় নিয়ে যায়। আমি তখন ঢাকায় বার্ষিক অতিথি পাখি। শীত এলেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে চলে যাই। তারা রাতে হোস্টেল থেকে বেরোতে পারে না। তাই মাঠে বসে এক চাদরে নিজেদের মুড়ে সারারাত গান শোনা হয় না আমাদের। আমি তাই প্রতিরাতে গান শোনা শেষে সকালে তার কাছে ছুটে যাই আর সে স্নাতক হয়ে বেরিয়ে আসে হোস্টেল থেকে। সে আমাকে জানিয়েছিলো, কফিবীজে অসংখ্য শ্রমিকের রক্ত ঘাম মিশে থাকে যেমন ধরো চা কিংবা চিনির ইতিহাসে। আমার ঘুমে চোখ টানে তাই আমি ওর কথায় বেশি কান দিই না। সে নিভৃত ঐ কফিকুটিরে আমার কানের লতিতে চুমু খায় আর হঠাৎ আমার সব ক্লান্তি কেটে যায়। কে না জানে, এই চির বৈষম্যের পৃথিবীতে চুমুর চেয়ে অধিক পুষ্টিকর, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত খাবার আজো অনাবিষ্কৃত। বেরোবার সময়, সিঁড়িতে আমার আরো কাছে ঘেঁষে আসে, খরগোশের মতো, বলে আমায় একটা চিঠি লিখবে চট্টগ্রামে ফিরে? আমি লিখেছিলাম। অনেক চিঠিই। স্বপ্নে ঘটা এসব আমাকে বাস্তব হরফে নিয়ে আসতে হবে এখন শান্তি পেতে গেলে, অন্তত একটা চিঠি লিখে।
২.
প্রিয় তারা,
কলকাতার কফিহাউস আমাদের নস্টালজিয়ার অংশ কিন্তু সেখানে কফি খেয়ে একদম শান্তি পাইনি । কফিহাউস গানটির নস্টালজিয়াই সম্বল । তুমি জানো, বেদনার গান আমি ঘৃণা করি । সম্বিত আর ওর আবাল্য আরাধ্যা স্তুতি ট্রিট দিয়েছিলো। বুঝেছিলাম, সুন্দরের স্মৃতি আমাদের করতলগত আর হবে না কোনোদিন। ষাটের আর সত্তরের কলকাতা, সেই বিকেলবেলার কফিশপে আমার সামনে লাফ দিয়ে চলে এসেছিলো। আমি যেন কৃষ্ণগোপাল মল্লিককে হন হন করে প্রুফের তাড়া বগলে হেঁটে যেতে দেখছি। পূর্ণেন্দু পত্রীর 'ছেঁড়া তমসুক' সিনেমায় যেমন সন্দীপন তার প্রিয় শক্তিদাকে ভূমির শায়িত দশা থেকে উঠতে বলছেন ঠিক সেই উচ্চারণেই যেন আমার অল্প সামনেই তিনি নতুন লেখা কোনো গদ্যের টুকরো পড়ে শোনাচ্ছেন সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীকে। কমলকুমারের উপন্যাস এইমাত্র আমার চোখের সামনেই প্রকাশিত হলো কৃত্তিবাসে আর তিনি অংশ ছিঁড়ে উপহার দিচ্ছেন গুণমুগ্ধদের। অন্যদিকে হ্যাংলা পাতলা নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় চাপা পড়ে যাচ্ছেন সত্যজিৎ ঋত্বিক মৃণাল সেনদের চাপে। তিনি কে বলো তো সোনা ! আরে ঐ যে তোমায় খগেন্দ্রনাথ মিত্রের 'ভোম্বল সর্দার' পড়িয়েছিলাম যা সেই সোভিয়েত আমলে চিরায়ত কিশোর সাহিত্য হিসেবে রুশ ভাষায় অনুদিত হয়েছিলো, সেই বইয়ের চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছিলেন নৃপেন বাবু। সে যে কি ফিল্ম তুমি না দেখলে ভাবতেও পারবে না ।
অন্য কথায় আসি, তুমি জানো, আরব বিশ্ব অনেক চিন্তকের জন্ম দিয়েছে। সভ্যতাকে একাধিক সুন্দর আবিষ্কার উপহার দিয়েছে তারা। তিন বেলা খাবার, মদ আর কফি আরব্য উপহার, সভ্যতার প্রতি। শ্রেষ্ঠ কফি বীজ আমরা এখনো অ্যারাবিকা নামেই চিনি। বহু রাস্তা পেরোতে হয়েছে তাকে। কয়েক শতাব্দী আগে মুসলমান মরমী সাধকরা একে আগলে রেখেছিলেন গুপ্তধনের মতো সযতনে। কফি সম্পর্কে ভাবলেই আমাদের মনে পড়ে, এক কাপ গরম ইতালিয়ান এসপ্রেসোর কথা , একটা ফরাসী ক্যাফে উ লেইত কিংবা মশলা মেশানো আমেরিকান ডাবল গ্রান্ডে ল্যাতের কথা।
হয়তো তুমি টেক্সটবুক থেকে ধারণা করো, আমেরিকা যে কফিপ্রেমিক জাতি হয়ে উঠলো তার পেছনের কারণটা হলো, রাজা জর্জের চায়ের উপর বর্ধিত কর আরোপ। আজকালকার প্রত্যেকটা বিমান বন্দরে সর্বব্যাপ্ত স্টারবাক, ক্যাফে নেরো আর কস্তা গ্রেসের যে এতো এতো দোকান তারা, কেমন করে নেসক্যাফে বিশ্বায়নের নম্র বিজ্ঞাপন হয়ে উঠলো দেখো একবার। লাতিন আমেরিকা, সাব সাহারান আফ্রিকা, ভিয়েতনাম আর ইন্দোনেশিয়ার মতো উষ্ণ আবহাওয়ায় কফি জন্মায়। এটিকে নতুন দুনিয়া থেকে তামাক আর চকলেটের মতো পাওয়া জিনিস ভাবলে তোমার ক্ষমা পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। শত হলেও এই তিনটি জিনিস প্রায় একই সময় অর্থাৎ ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে বিখ্যাত হয়ে ওঠে ইউরোপে। মূলত, লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্তের দেশগুলোর উঁচু এলাকা থেকে কফি আসে। যেমন – ইয়েমেন আর ইথিউপিয়া। কেন যে লোহিত সাগরের হাঙর বইটার কথা মনে পড়লো টিনটিনের! অপ্রাসঙ্গিক জিনিস মানুষ বেশি ভাবে হয়তো ।
যদিও বন্য কফি বীজ থেকেই এই পানীয়টি তৈরি তবু ধারণা করা হয় ইথিওপিয়ান মালভূমির কোনো কিংবদন্তি মেষপালক প্রথমবারের মতো কফি পান করেছিলেন। ইয়েমেনেই কফি চাষের প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া যায়। কাহওয়া নামটি ইয়েমেনীদের দেয়া, কফি আর ক্যাফে শব্দ দুটি ওখান থেকেই এসেছে। কাহওয়া শব্দের আদত অর্থটি হচ্ছে মদ বা সুরা। ইয়েমেনের সুফী মরমী সাধকেরা মনোযোগের একটি পদ্ধতি হিসেবে কফি পান করতেন। ঈশ্বরের নামগান করবার সময় আধ্যাত্মিক আবেশ নির্মাণের প্রয়োজন হলেও তাঁরা কফি পান করতেন। ১৪১৪ সালের দিকে এটি মক্কায় পরিচিত হয়ে ওঠে আর পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে ইয়েমেনী বন্দর মোকার মাধ্যমে সারা মিশরে ছড়িয়ে পড়ে। তখনো সুফীদের সাথে এর সম্পর্ক ছিলো। কায়রো শহরের ধর্মশিক্ষার কেন্দ্র আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে অনেকগুলো কফিশপ গড়ে ওঠে। সিরিয়াতেও কফি লোকপ্রিয় পানীয় হয়ে ওঠে । সিরিয়াতেও দোকান খুললো কফির , বিশেষ করে বিশ্বজনীন শহর আলেপ্পোতে আর তার বাদে বিশাল অটোমান তুর্কী সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তানবুলে, ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে।
ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ মক্কা, কায়রো আর ইস্তানবুলে কফি নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলো। জ্ঞানী শায়খরা কফির প্রভাব মদের মতো কি না সেটা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন কফির পাত্রের হাতবদল মদের পাত্র বিনিময়ের সমতুল্য যা কি না ইসলামে নিষিদ্ধ। কফি হাউসগুলো মানুষের একত্রিত হয়ে কথা বলার, কবিদের কথা শোনার আর দাবা, ব্যাকগ্যামন এসব খেলার এক নতুন জায়গা হয়ে উঠলো। বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের একটা কেন্দ্র হয়ে উঠলো কফি হাউস এবং একত্রিত হওয়ার স্থান হিসেবে এটিকে মসজিদের কঠিন প্রতিযোগি হিসেবে দেখা হতে লাগলো।
কোনো কোনো পণ্ডিত ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, কফি হাউস মদ্যপানের জায়গা থেকেও খারাপ। কর্তৃপক্ষ খেয়াল করতে লাগলেন, কেমন করে এসব জায়গাগুলো সহজেই নেশার আড্ডাখানা হয়ে উঠছে। যা হোক, চতুর্থ মুরাদ ( ১৬২৩-৪০) এর আমলে কফি সেবনকারীদের মৃত্যুদন্ড দেয়ার বিধান করলেও কফি নিষিদ্ধ করবার সকল চেষ্টা মাঠে মারা গেলো। ধর্মীয় পণ্ডিতরা শেষ পর্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্তে এলেন, কফি পান করা নৈতিকভাবে অনুমতিযোগ্য। দুই পথে কফির জয়যাত্রা ইউরোপে সম্প্রসারিত হয়েছে – অটোমান সাম্রাজ্যের মাধ্যমে আর প্রকৃত কফিকেন্দ্রিক বন্দর মোকার মাধ্যমে সমুদ্রে ছড়িয়েছে। ইংরেজ আর ওলন্দাজ, দুই দেশের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে মোকা বন্দরে কফির প্রধান ক্রেতা ছিলো। তাদের কার্গো নিজেদের কাছে নিয়ে যেতো কেপ অফ গুড হোপ হয়ে। ভারতে ও তার বাইরেও রপ্তানি করতো।
তারা সম্ভবত ইয়েমেনি কফি উৎপাদনের সামান্য একটা অংশই নিয়েছিলো কেন না বাকিটা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশে চলে যেতো। কফিবাণিজ্য দানিউবের দিকে আসতে থাকা তুর্কি সেনাবাহিনি বাহিত হয়ে মেডিটেরানিয়ান পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছে। মধ্যপ্রাচ্যে কফিহাউস, মানুষের আড্ডা, পড়াশোনা, দাবা তাসের মতো ইন্ডোর গেমস আর দৈনন্দিন মতবিনিময়ের কেন্দ্র হয়ে উঠলো। নাশকতামূলক কাজকারবারের সন্দেহে এসব সম্মিলন একবার দ্বিতীয় চার্লস ১৬৭৫ সালে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ঘোষণায় বলা হয়েছিলো, 'এসব জায়গায় সন্দেহজনক লোকেরা আড্ডা দেয় আর রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করে।' শতাব্দীখানেক বাদে, বিখ্যাত প্যারিসের কফিশপ প্রকোপে মারা, দাঁতো আর রোবেসপিয়েরকে বিপ্লবের পরিকল্পনা করতে দেখা যাবে। প্রথমদিকে ইউরোপে কফিকে ইসলামী পানীয় হিসেবে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছিলো। কিন্তু ১৬০০ খিস্টাব্দে পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট কফিতে মজে গিয়ে ঘোষণা দেন, কেবল মুসলমানরা একচ্ছত্র বাণিজ্য করবেন – এই ঘটনা মেনে নেয়া ঠিক হবে না এবং সেইকারণেই এটিকে বাপ্তির আওতায় আনতে হবে। দেখা যাচ্ছে, তারপর থেকে খ্রিস্ট্রিয় ধর্মীয় উৎসবেও কফি অন্যতম প্রধান উপাদান হয়ে উঠলো। অস্ট্রিয়ায় কফি পান ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বার পেছনে ১৬৮৩ সালে ভিয়েনায় তুর্কি আক্রমণ নিয়ামক ঘটনা। তারা হেরে গেলে বিজয়ী পক্ষ প্রচুর কফি বাজেয়াপ্ত করে।
এখনো ভিয়েনায় এক গ্লাস জলের সাথে কফি সার্ভ করা হয়। তার পেছনে হয়তো এই ইতিহাসটাই। ছোটো কাপে শক্তিশালী তুর্কি কফি, কাপের তলায় ইস্তানবুল দামাস্কাস বা কায়রোর কড়া উপাদান যা স্নায়ুকে সতেজ করে। এটা কি শুধুই কাকতাল না ঋণী থেকে ভুলে যাওয়ার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আমরা জানি না।
আমরা যে পানীয়কে আদর করে টার্কিশ কফি বলে ডাকি সেটা আসলে খানিকটা ভুলভাবে ধরে নেয়া নাম যদিও তুরস্ক হচ্ছে শুধুই একটা দেশ যেখানকার মানুষজন কফি পছন্দ করে। গ্রিসে এটিকে 'গ্রিক কফি' বলে। মিশরীয়, লেবানিজ, প্যালেস্তাইন, জর্দানের লোকজন বা অন্যেরা কফির নাম নিয়ে এতটা ভাবিত নয়, তারা খেয়েই খুশি।
নামে কি এসে যায় বলো! এই যেমন তুমি, ইতিহাসে ও ভুগোলমতে সৈকতের আকাশের চির ফুটে থাকা তারা। আমাদের গ্রিসে থিও এঞ্জেলোপুলুসের কবরে তাঁর প্রিয় ফুল রাখতে এই জন্মে আর যাওয়া হলো না তারা, শোনা হলো না অর্কেস্ট্রা ভিয়েনায়। তুমি থাকলে কতো পরিকল্পনার পরি স্বাস্থ্যবতী হয়ে উঠতো। তখন নিশ্চয় কফির পাশেই রাখা রাখত জলের গ্লাস। সেখানে কি গুলশান দুইয়ের মতো নিভৃতি আছে!
আরব বিশ্বে আরেকটি বিশেষ কফি পানের ঐতিহ্য আছে। উপসাগরীয় এলাকায় পরিচিত কফি অনেকটাই তেতো আর কখনো নানা মশলা মিশিয়ে স্বাদু ও সুগন্ধি করে তোলা হয়। একজন অতিথি এলে সম্মানজনক বিরতির পর প্রায়ই এই কফি পরিবেশিত হয়। তাড়াতাড়ি পরিবেশন করা অসম্মান বলে ধরে নেয়া হয়, অতিথির বিদায়ের সময় আরেকবার দেয়া হয়। এটা প্রায় সময়েই এক কাপ কালো, মিষ্টি চায়ের আগে বা পরে পরিবেশন করা হয়। চা বা কফি আগে পরে দেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট তাৎপর্য নেই। পশ্চিমা অতিথিরা সম্পূর্ণ দুই ধরণের পানীয়ের নিখুঁত এবং দ্রুত পরিবেশনে আশ্চর্য হতে পারেন, এটিই বিশেষভাবে খেয়াল করবার জিনিস। বেদনাদায়কভাবে এখন একটিও আরব দেশ শীর্ষ কফি উৎপাদনের তালিকায় নেই।
উত্তর দিও সময় পেলে। যদিও আমার ভালোবাসাটকু তোমার উপস্থিতিসাপেক্ষ নয়।
৩.
সন্ধ্যাতারা আর উত্তর দেয়নি। স্বপ্নে শুরুটা ঘটেছিলো বা বাস্তবে, এখন আর নিশ্চিত নই। হয়তো জাকির হুসেনের তবলাবাদন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো সেই মাঠের গ্যালারির এক কোণায়।
আর স্বপ্নে তারা ফুটেছিলো উজ্জ্বল হয়ে।