সৌদি-আমিরাত অন্তর্কোন্দলে ভাঙতে পারে ওপেক জোট
১৯৬০ সালে গঠিত হলেও তার পরের বছর থেকে কার্যকর হয় প্রধান প্রধান জ্বালানি তেল উত্তোলক দেশগুলোর জোট ওপেক, যা আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু, দীর্ঘ এই কয়েক দশকের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে জোটটি, এমনকি ভাঙ্গনের সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে প্রভাবশালী দুই সদস্য দেশ সৌদি আরব ও আমিরাতের অন্তর্কোন্দলের কারণে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভেতরে ভেতরে চরম তিক্ত হয়ে উঠেছে সৌদি ও আমিরাতের ওপেক-বিষয়ক সম্পর্ক, যা জোটের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ওপেক এবং রাশিয়ার মতো জোট বহির্ভূত বিশ্বের অন্যতম কিছু শক্তিশালী জ্বালানি তেল উৎপাদক দেশগুলো মিলে ২০১৬ সালের শেষে গঠিত হয় ওপেক প্লাস। গত সপ্তাহে ওপেক প্লাসের বৈঠকে বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নতুন তেল উৎপাদন নীতি নির্ধারণে ঐক্যমত্য হয়নি। তারপর চলতি সপ্তাহে গত সোমবারের বৈঠকও ভেস্তে গেছে। এ বাস্তবতায় আলোচনার নতুন তারিখ এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। যেকারণে, জুলাইয়ের পর থেকে জ্বালানি তেল উত্তোলন, পরিশোধন, রপ্তানি বৃদ্ধির মতো উৎপাদন নীতি কার্যকর স্থবির হয়ে পড়লো।
বৈশ্বিক চাহিদা পুনরুদ্ধারের সময় এ অচলাবস্থা আন্তর্জাতিক জ্বালানি সরবরাহকে অনিশ্চিয়তায় ফেলছে।
এব্যাপারে কানাডার টরেন্টো ভিত্তিক বাজার বিশ্লেষক আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটস-এর বৈশ্বিক পন্যবাজার কৌশল শাখার প্রধান হেলিমা ক্রফট এক গবেষণা নোটে লিখেছেন, "গত বছর সৌদি আরব ও রাশিয়ার মূল্যযুদ্ধের কারণে ওপেক প্লাস সবচেয়ে গভীর সংকটে পড়েছিল। সেই বিরোধ নিরসনে এখনও নেপথ্য আলোচনা চলছে। কিন্তু, তারমধ্যেই আরব আমিরাতের সঙ্গে নতুন করে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো সৌদির। এই অবস্থায় নিকট ভবিষ্যতে সংযুক্ত আরব আমিরাত জোট সদস্য থাকবে কিনা- সেই প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে।"
ক্রফট জানান, সৌদি-আমিরাত তিক্ততা শুধু তেল নীতি নির্ধারণ ঘিরে নয়, "বরং আবুধাবি চায় রিয়াদের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজস্ব আন্তর্জাতিক নীতি গ্রহণের স্বাধীনতা।" অর্থাৎ, বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত থেকেই বিরোধের সূত্রপাত বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
ওপেক প্লাসে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেল উৎপাদক দেশগুলোর আধিপত্যই বেশি। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতনের কারণে তারা একযোগে বড় মাপের সরবরাহ কর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। মহামারির প্রথম বছরে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদায় রেকর্ড ধস নামার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় তারা। এরপর থেকেই প্রতিমাসের উৎপাদন নীতি নির্ধারণে মাসিক বৈঠক করে আসছে সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক প্লাস।
হারিয়েছে ওপেকের সংহতি:
গত শুক্রবার আগষ্ট থেকে আরও ২০ লাখ ব্যারেল এবং চলতি বছরের শেষপর্যন্ত মাসিক ৪ লাখ ব্যারেল হারে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির একটি প্রস্তাবে ওপেক প্লাস সদস্য দেশগুলো ভোট দেয়। তবে ওই প্রস্তাবনায় বিদ্যমান হারে সরবরাহ কর্তন ২০২০ সাল পর্যন্ত ধরে রাখার সুপারিশও ছিল।
আমিরাত এসব পরিকল্পনাকে মেনে নেয়নি। দেশটি তার নিজস্ব উৎপাদন বাড়াতে আরও বেশি কোটা চায়, সাম্প্রতিক গোলযোগের সূত্রপাত এ ভিন্নতা থেকেই।
এনিয়ে পিভিএম অয়েল অ্যাসোসিয়েটসের তেল বাজার বিশ্লেষক টামাস ভার্গা এক গবেষণা নোটে বলেছেন, "ওপেক প্লাসে এখনও কোনো সমঝোতার খবর পাওয়া যায়নি। জোটটি টিকে গেলে হয়তো জুলাইয়ের মাত্রাতেই বাকি বছর জুড়ে তেল উৎপাদন করবে।"
"বৈঠকের অমীমাংসিত ফল নিকট ও সুদূর ভবিষ্যতে জ্বালানি তেল চাহিদা-সরবরাহের ভূ-প্রকৃতি নির্ধারণ করতে চলেছে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে মতবিরোধ নিয়ে চলতি সপ্তাহে বিরল এক প্রকাশ্য বাগযুদ্ধে লিপ্ত হন সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের জ্বালানি মন্ত্রীরা। উভয়েই নিজ নিজ অবস্থানকে সমর্থন করে যুক্তি দিয়েছেন।
আমিরাতের জ্বালানি ও অবকাঠামো মন্ত্রী সুহেল আল মাজারুয়ি মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসি'কে বলেন, "আমাদের জন্য এই প্রস্তাব ভাল ছিল না।" স্বল্প-মেয়াদে উৎপাদন বৃদ্ধির নীতিকে সমর্থন করলেও, ২০২২ সাল নাগাদ আমিরাত নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধিতে আরও সুবিধা চায় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল আল-আরাবিয়াকে গত রোববার দেওয়া সাক্ষাৎকারে সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী আব্দুল আজিজ বিন সালমান সোমবারের বৈঠকে যুক্তিপূর্ণ সমঝোতার আহবান জানান।
এরপর সোমবার হোয়াইট হাউজের এক মুখপাত্র জানান, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই ঘনিষ্ঠ মিত্রের মধ্যে একটি সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ওপেক সদস্য না হলেও বৃহৎ জ্বালানি তেল উৎপাদক ও ক্রেতা। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে থাকায় ওপেকের সাম্প্রতিক আলোচনার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিবিড় পর্যবেক্ষণ বজায় রেখেছে।
ওপেক জোটের যেকোনো সিদ্ধান্তহীনতা অপরিশোধিত তেলের বৈশ্বিক বাজারকে আগামী বছরেও প্রভাবিত করবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বড় কারণ।
তবে সোমবার সমঝোতা ছাড়াই বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার খবর প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ভিত্তিক বাজার পরামর্শক এগেইন ক্যাপিটালের অংশীদার জন কিলডাফ বলেন, "আজ ওপেকের সংহতি মিলিয়ে গেছে। মহামারির অভিঘাতে সদস্য দেশগুলো এক হয়েছিল, আবার মহামারির কারণেই তাদের ঐক্য ভেঙ্গে পড়েছে। মূল উৎপাদন মাত্রা বৃদ্ধির দাবিতে আরব আমিরাত অটল থাকায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো।"
"আসল খেলা এখন শুরু হলো; এবার দেখা যাবে জোট থেকে কোন দেশ বেড়িয়ে যায়," তিনি যোগ করেন।
তবে সাম্প্রতিক অচলাবস্থা ঘিরে প্রতিক্রিয়া জানার জন্য সিএনবিসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষনিকভাবে কোনো মন্তব্য জানায়নি ওপেক।
- সূত্র: সিএনবিসি