উদ্ভিদ থেকে তৈরি হবে করোনা টিকা?
বিশ্বেজুড়ে বিভিন্ন দেশের টিকা উৎপাদন ক্ষমতার অস্বাভাবিক বৈষম্য প্রকাশ্যে এসেছে করোনা মহামারির বদৌলতে। প্রচলিত টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল। উৎপাদনের প্রযুক্তি, মানবসম্পদ ও তহবিল মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর যেসব দেশের টিকা উৎপাদন ক্ষমতা আছে, তারা এই মহামারিতে শত শত কোটি কোভিড টিকা উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ফলে এই দেশগুলোও টিকার মান নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণে হিমশিম খেয়েছে।
প্রচলিত টিকা ঠান্ডা পরিবেশে সংরক্ষণ ও পরিবহন করতে হয়। কিছু টিকার সংরক্ষণ-পরিবহণের জন্য মাইনাস ৭৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা প্রয়োজন। টিকা ঠান্ডা রাখার এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং সীমাবদ্ধ অবকাঠামোর দেশগুলোতে টিকা পৌঁছানোর সবচেয়ে বড় বাধা টিকা ঠান্ডা রাখার এই প্রক্রিয়া বা হিমচক্র। কিছু বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, এই সমস্যার সমাধান হলো টিকা উৎপাদনের জন্য উদ্ভিদের ব্যবহার।
মানুষের ব্যবহারোপযোগী কোনো ভেষজ টিকা এখনও আবিষ্কৃত হনি। তবে এরকম বেশ কয়েকটি টিকা পাইপলাইনে আছে।
কানাডার জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা মেডিক্যাগো একটি ভেষজ কোভিড-১৯ টিকা বানিয়েছে। এটি এখন মানব ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ভেষজ ফ্লু টিকার সবগুলো মানব ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে। এটি এখন কানাডা সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
গত ডিসেম্বরে, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির মার্কিন জৈবপ্রযুক্তি শাখা কেন্টাকি বায়োপ্রসেসিং ঘোষণা দিয়েছিল যে, তাদের ভেষজ কোভিড-১৯ টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপ শুরু হচ্ছে।
জাপানি মালিকানাধীন আইকন জেনেটিক্স জিএমবিএইচ উদ্ভিদ থেকে বানানো করোনাভাইরাস টিকার মানব ট্রায়াল শুরু করে গত অক্টোবরে।
আবার, দক্ষিণ কোরিয়া সরকারও ভেষজ ভ্যাকসিন গবেষণার জন্য ১,৩৫০ কোটি ডলারের বিশাল বিনিয়োগ করেছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী অক্টোবরে পোহাং শহরে দেশটির প্রথম ভেষজ টিকা উৎপাদন কারখানা চালু হবে। ভেষজ টিকার বাজারমূল্য আগামী সাত বছরে ৪ কোটি ডলার থেকে ৬০ কোটি ডলারে ঠেকবে বলে অনুমান।
প্রচলিত টিকার সমস্যা:
ভেষজ টিকা প্রযুক্তির ধারণা নতুন নয়, অন্তত ৩০ বছরের পুরনো। ডেঙ্গু, পোলিও, ম্যালেরিয়া ও প্লেগের টিকা তৈরির জন্য আলু, চাল, পালংশাক, ভূট্টা ও অন্যান্য উদ্ভিদ ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, এগুলোর কোনোটির মানব ট্রায়ালই শেষপর্যায় পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এর কারণ সম্ভবত জৈবপ্রযুক্তির উত্থান।
২০০৬ সালে মার্কিন কৃষি বিভাগ হাঁসের নিউকাসল রোগের জন্য একটি ভেষজ টিকার অনুমোদন দেয়। কিন্তু, মানুষের ব্যবহারের জন্য এপর্যন্ত কোনো ভেষজ টিকা অনুমোদন পায়নি।
টিকা তৈরির জন্য বিজ্ঞানীদের গণহারে অ্যান্টিজেন উৎপাদন করতে হয়। সাধারণ অ্যান্টিজেনের মধ্যে আছে নিষ্ক্রিয় বা মৃত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া, টক্সিন, অথবা কোভিড-১৯-এর স্পাইক প্রোটিনের মতো ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল প্রোটিন। ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না ভ্যাকসিনের জন্যও ব্যয়বহুল কারখানায় এমআরএনএ অণুর গণ-উৎপাদন করে পরিশোধিত করতে হয়।
প্রচলিত টিকার অ্যান্টিজেন তৈরি হয় কোনো ভাইরাস বা ভাইরাল জেনেটিক কোডের সাহায্যে, ল্যাবরেটরি-নিয়ন্ত্রিত কোষকে সংক্রামিত করে (পোকামাকড়, বানরের কিডনি, হ্যামস্টারের ডিম্বাশয় কিংবা অন্যান্য প্রাণীকোষ)। কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে বড় বড় ধাতব বায়ো-রিঅ্যাক্টরে নতুন কোষ সৃষ্টি হয়। শেষে দীর্ঘ ও জটিল বিশোধন প্রক্রিয়ার পর শিশিতে পোরা হয় নতুন সৃষ্ট কোষগুলোকে।
মুশকিল হলো, বায়ো-রিঅ্যাক্টর অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মীর প্রয়োজন। আর এই পদ্ধতিতে দূষণের ঝুঁকিও বেশি। তাই বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিজেন উৎপাদনকারী বায়ো-রিঅ্যাক্টরকে পৃথক ভবনে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, জীবাণুমুক্ত পরিবেশে রাখতে হয়।
উৎপাদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে ও জনবল সংকটের কারণে মহামারিকালে যথেষ্ট পরিমাণে কোভিড টিকা উৎপাদন করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিসাব অনুসারে, ২৫ বছর ধরে কেবল তিনটি টিকা উৎপাদন করে এমন একটি কারখানার রক্ষণাবেক্ষণের পেছনেই ১৫০ কোটি ডলার খরচ হয়।
টিকা উৎপাদক হিসেবে উদ্ভিদ:
ভেষজ টিকা উৎপাদনের জন্য বায়ো-রিঅ্যাক্টরের প্রয়োজন নেই। কারণ, উদ্ভিদ নিজেই বায়ো-রিঅ্যাক্টর। আবহাওয়া-নিয়ন্ত্রিত ফার্মাসিউটিক্যাল-গ্রেড গ্রিনহাউসে উদ্ভিদ জন্মানো যায়। এর ফলে গাছ পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গমুক্ত থাকে। আলাদা করে গাছগুলোকে আর জীবাণুমুক্ত পরিবেশে রাখতে হয় না।
মেডিক্যাগোর উত্তর ক্যারোলিনার গ্রিনহাউসে একটি ইস্পাতের ট্রে-তে নিকোটিয়ানা বেন্থামিয়ানা নামের ১২৬টি উদ্ভিদ জন্মানো হয়েছে। এটি সিগারেট তৈরিতে ব্যবহৃত অস্ট্রেলিয়ান তামাকের জাতভাই। সেখানে এই গাছগুলোকে বিশোধন করে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে মিনি বায়ো-রিঅ্যাক্টরে পরিণত করা হয়। তারপর গাছগুলোর কোষে অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে ভাইরাল ডিএনএ স্থানান্তরের মাধ্যমে লাখ লাখ ভাইরাসসদৃশ নতুন কণা তৈরি করা হয়। এই কণাগুলো অ্যান্টিজেন হিসেবে কাজ করে—এবং সংক্রামক নয়।
পাঁচ-ছয় দিন পর গাছগুলোর পাতা শুকিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কাটা হয়। তারপর ওগুলোকে পরিশোধিত করা হয়। এভাবে উৎপন্ন হয় ভেষজ টিকা। ২০১৮ সালে পৃথিবীর প্রথম ভেষজ টিকা হিসেবে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করে মেডিক্যাগোর ফ্লু ভ্যাকসিন।
প্রচলিত টিকার ভাইরাস আলাদা করার পর ওগুলোকে ঠান্ডা পরিবেশে রাখতে হয়। মেডিক্যাগোর ভেষজ ফ্লু এবং কোভিড-১৯ টিকাও ঠান্ডা পরিবেশে সংরক্ষণ করতে হয়।
তবে অন্যান্য ভেষজ টিকা উৎপাদনে পরিশোধন ধাপ বাদ গিয়ে এই সমস্যা এড়ানো হয়। টিকা উৎপাদনের জন্য জেনেটিক্যালি মডিফাইড লেটুস বহুল ব্যবহৃত। এ ধরনের লেটুসের জিন যেহেতু সম্পাদনযোগ্য, তাই এ উদ্ভিদের অ্যান্টিজেনসমৃদ্ধ ক্লোরোপ্লাস্টকে পরিশোধিত করার দরকার পড়ে না। এই লেটুসের ক্লোরোপ্লাস্ট গুঁড়ো করে তা দিয়ে বড়ি বা ক্যাপসুল তৈরি করা হয়। এই টিকা মুখে নিয়ে খেতে হয়।
মানুষ ও প্রাণীর জন্য লেটুসভিত্তিক তৈরির গবেষণা এখনও চলছে। এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনও শুরু হয়নি।
বড়ি আকারের টিকার সুবিধা হচ্ছে, এটি কক্ষ তাপমাত্রায়ই দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। ফলে ঠান্ডা পরিবেশে সংরক্ষণের সমস্যা আর থাকে না।
ভেষজ টিকা তৈরিতে খরচ কেমন হয়, তা এখনও প্রকাশ্যে জানানো হয়নি। তবে বায়ো-রিঅ্যাক্টরে তৈরি প্রচলিত টিকার চেয়ে ভেষজ টিকার উৎপাদন খরচ যে অনেক কম হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা বায়ো-রিঅ্যাক্টর স্থাপনা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ হয়। তারপর ভাইরাস বিশোধন ও ঠান্ডা পরিবেশে সংরক্ষণের খরচ তো আছেই।
উদীয়মান ভেষজ টিকা প্রযুক্তি যে কেবল বর্তমান ও ভবিষ্যত মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিরাট অবদান রাখবে, তা নয়; এ প্রযুক্তিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোও বিপুল পরিমাণ টিকা উৎপাদন করতে পারবে। ফলে দূর করা যাবে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অস্বাভাবিক টিকা-বৈষম্য।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডটকম