বরাবরের মতোই লকডাউনের ভুক্তভোগী নিম্ন আয়ের মানুষ
দেশব্যাপী করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান কঠোর লকডাউনে বরাবরের মতো চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। কীভাবে সংসার চালাবেন, কীভাবে সামনের দিনগুলো কাটবে এ নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই।
দীর্ঘ দেড় বছরের করোনা মহামারিতে ঋণ করে জীবন ধারণের চেষ্টায় থাকা অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ ঋণ পরিশোধের শঙ্কায় কাটাচ্ছেন দিন।
রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি ও নিম্ন আয়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকে কোথাও থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাননি।
কেউ কেউ বলছেন, কোরবানির ঈদে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে খয়রাতি সহায়তা, মাংস পেলেও সেটা নিয়ে বেশিদিন কাটানো কঠিন।
নিম্নআয়ের এসব মানুষ বলছেন, লকডাউনে সব বন্ধ থাকে কিন্তু তাদের সংসারের খরচ বন্ধ থাকে না। পেটে খাবার দিতেই হয়। এখন তাদের চাওয়া, সরকার যেন তাদের সহায়তা করে।
বৈশাখি গাড়ির হেলপার মো. ইসমাইল। তিনি থাকেন কল্যানপুর বস্তিতে। ইসমাইল বলেন, "লকডাউনে গাড়ি বন্ধ। আমাদের উপার্জনও বন্ধ। করোনা আসার পর যতগুলো লকডাউন দেওয়া হলো, সেখানে কখনো কেউ আমাদের সহায়তা করেনি। না সরকার, না কোনও এনজিও। আমরা খুবই খারাপ অবস্থায় আছি।"
ইসমাইলের ছোট ভাই হজরত আলী রাজধানীতে রবরব গাড়ি চালান । লকডাউনে কাজ না থাকায় গ্রামের বাড়ি চলে গোছেন। ইসমাইল বলেন, "ছোট ভাই ১৫ হাজার টাকা ঋণ করেছে। এখন ঢাকায় চলতে না পেরে গ্রামে চলে গেছে।"
হানিফ পরিবহনের হেলপার আব্দুল দেওয়ান মান্নান। করোনা আসার পরে ৬০ হাজার টাকা ঋণ করেছেন। তিনি বলেন, "আমরা কোনও সহায়তা পাইনি। শুনেছি সরকার পরিবহন শ্রমিদের অনুদান দিচ্ছে, আমাদের প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিয়েছি, কিন্তু কোন সহায়তা পাই নি। ৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। করোনা আমাদের ভয় না, কাজ আর আয় হারানোই ভয়।"
মো. পারভেজ আগে রাজধানীতে একটি বাস চালাতেন। করোনার শুরুতে তার চাকরি চলে যায়। এরপর কিছুদিন লেগুনা চালানোর পর ১০ হাজার টাকা বেতনে একজনের ব্যক্তিগত গাড়ি চালান। লকডাউন হওয়ার পর সে কাজও বন্ধ। পারভেজ বলেন, "মালিক বলে দিয়েছে এখন বেতন দিতে পারবেন না, গাড়িও বের করবে না। এখন মা, বাবাকে নিয়ে কীভাবে সামনের দিন পার করবো সেই চিন্তা।"
একই অবস্থা নৌ শ্রমিকদেরও। লঞ্চ বন্ধ থাকায় সদরঘাটে অলস বসে আছেন অনেকেই। কেউ কেউ বিকল্প কাজের খোঁজে মাঠে নেমেছেন। তাঁদেরই একজন রাজীব। ভোলার মেহেন্দিগঞ্জের ছেলেটি রিকশা ভ্যানে সবজি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তিনি বলেন, "বাঁচতে হলে কিছু করতেই হবে।"
তার আরেক সহকর্মী তারেক। অভ্যাস না থাকলেও পরিচিত একজনের সহায়তায় রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছেন। বললেন, "অভ্যাস নাই, তাই অনেক কষ্ট। কিন্তু উপায় নাই, বাঁচতে হবে।"
নুর হোসেন কল্যানপুর বস্তির রাস্তার সামনে চার বছর ধরে একটি চায়ের দোকান দিয়েছেন। ভালোই চলছিল তার ব্যবসা, কিন্তু করোনা আসার পর তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। নুর হোসেন জানান, ছয় মাস আগে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি। এখন না পারছেন কিস্তির টাকা দিতে, না পারছেন সংসারের খাবার খরচ যোগাতে। নুর হোসেন বলেন, সামনে অন্ধকার দেখছি।
নিরু একটি বাসায় রান্নার কাজ ও ধোয়ামোছার কাজ করতেন। লকডাউনে তার কাজ বন্ধ। স্বামী নির্মাণ শ্রমিক, এখন তারও কাজ নেই।
নিরু বলেন, "৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাই। এখন কাজ না করতে পারলে টাকা শোধ করবো কীভাবে। গত বছর করোনার শুরুতে ৫ কেজি চাল, এক কেজি আলু ও এক কেজি ডাল দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে আর সরকারের কোন সহায়তা পাইনি।"
কল্যানপুর বস্তিতে এক ঘরে পাঁচজন নিয়ে থাকেন নিরু। তিনি বলেন, "স্বাস্থ্যবিধি আমরা বুঝি না। আমরা কাজ চাই। কাজ করতে পারলে ভাত খেতে পারবো এটা বুঝি।"
ভবন ভাঙার কাজ করেন মিরাজ , আলম ও মন্টু ব্যপারি। কল্যানপুরে একটি চায়ের দোকানে তাদের সঙ্গে কথা হয়। লকডাউনে কাজ নেই তাই অলস বসে রয়েছেন তারা।
মো . মিরাজ বলেন, "লকডাউনে গাড়ি না চললে আমরা কাজে যেতে পারি না। কাজ থাকে মোহম্মদপুর, মিরপুর ১৪ এসব এলাকায়। মো. আলম, বলেন, আমরা এখন ধারদেনা করে চলছি। আমাদের দেখার কেউ নেই। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে আগামীকাল কী খাবো সেই কথা বলতে পারছি না। চায়ের দোকানে বসেছি যদি কোন কাজের সন্ধান পাই।"
কল্যানপুর বস্তিতে আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি মানুষের বাসায় রান্নার কাজ করতেন। বলেন, "করোনার শুরুতে কাজ হারিয়েছি। ছেলেটা গাড়ি চালাতো এখন লকডাউনে সেটাও বন্ধ। ঘরে পান্তা ভাত রয়েছে, অসুস্থ আমি এই ভাত খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। দুই বছর হয় কাজ করতে পারছি না। নিজে অচল হয়ে গেছি এখন কীভাবে বাঁচবো। ছোট থেকেই ঢাকায় আছি, স্বামী মারা গেছে বিধবা ভাতাও পাই না। এখন পেটে খাবার দিব, না বাসা ভাড়া দিব, না ডায়বেটিসের ওষুধ কিনবো।"
আনোয়ারার পাশেই ইসমাইল হোসেনের রুম। ছয় মাস ধরে চোখে দেখতে পারেন না ইসমাইল হোসেনস। পাশে থাকা তার স্ত্রী মঞ্জু বলেন, "আমার স্বামী চোখে দেখেন না। আমি বাসা বাড়িতে রান্নার কাজ করতাম সেটাও লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেছে। সাত মেয়ে এক ছেলে নিয়ে আমরা খুব কষ্টে আছি।"
কান্নাভরা কন্ঠে মঞ্জু বলেন, "আমরা সরকার থেকে কোন সহায়তা পাইনি। আমাদের সরকার থেকে কোন সাহায্য এনে দেয়া যায় কিনা দেখুন"
লকডাউনে বিপাকে পরেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরাও। তাদের বেশিরভাগই সরকারি-বেসরকারি সহায়তা তালিকার বাইরে রয়েছে।
আবু হানিফ ৫ বছর ধরে সিএনজি চালান। থাকেন মগবাজার এলাকায়। তিনি বলেন, "গাড়ির চাকা ঘুরলে ইনকাম, না ঘুরলে কোন আয় নেই। আমি বুঝলাম না সরকার কেন সিএনজি বন্ধ করলো। জরুরি প্রয়োজন বা যে রোগীরা এখন হাসপাতালে যাবে তারা কীভাবে যাবেন। সবাইতো আর অ্যাম্বুলেন্সে যান না।"
আবু হানিফ বলেন, "গাড়ি বন্ধ করেছে সরকার, কিন্তু আমাদের খাবারতো দিল না। এখন আমরা কী খাব আর গ্রামে পরিবারকে কীভাবে টাকা পাঠাবো। আমাদের কথা শোনারও কেউ নেই।"
বিপাকে নন–এমপিও শিক্ষকরাও
রাজধানীর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড গার্লস কলেজের ইংরেজি শিক্ষক মো. রেজা। তিনি বলেন, "কী বলবো ভাই, আমি নন-এমপিও শিক্ষক তাই সরকার থেকে কোনও টাকা পাই না। এখন ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালাই। লকডাউনে সেটাও বন্ধ। আমাদের কথা কি সরকার শুনবে? কত মাস হয়েছে স্কুল বন্ধ, তাই বেতন পাই না। বাসায় খাবার থাকলে লকডাউন ভালো লাগে। যার বাসায় খাবার নেই সে বুঝে লকডাউন হলে কেমন চিন্তা।"
মো. রেজা তিন জন সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন মোহম্মদপুরের একটি ভাড়া বাসায়।
পাবনা সুজানগরের নতুন বাজার হাইস্কুলের শিক্ষক মো. সাগরও নন-এমপিও শিক্ষক। করোনা সংক্রামণের জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় এখন তিনি নিয়মিত বেতন পান না। সংসারের খরচ যোগাতে তিনিও ভাড়ার মোটর সাইকেল চালান।
মো. সাগর বলেন, "হাতে অর্থ নেই, ভিক্ষা করারও উপায় নেই। আমরা না পারছি সইতে, না পারছি কারও কাছে হাত পাততে। সমাজে আমাদের একটা অবস্থান আছে তাই কারও কাছে সাহায্যও চাইতে পারি না।"
এলাকায় কোনও কাজ না পেয়ে ঢাকায় এসে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলেন মো. সাগর। কিন্তু সেখানে তিন মাস কাজ করলেও বেতন না দেওয়ায় চাকরি ছেড়ে ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালান তিনি।
মো. সাগর বলেন, "এখনতো কেউ ভিক্ষাও দেবে না। এবার কঠোর লকডাউন কোনও কিছু চলে না, গার্মেন্টসও খুলছে না।"
তিনি বলেন, "করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ১৭ মার্চ থেকে সরকার সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। সরকারি শিক্ষকরা ঘরে বাসে বেতন পান। কিন্তু আমাদের তো সেই উপায় নেই। সরকারের কোন সহায়তাও আমরা পাই নি।"