কোভিড চিকিৎসার বিল মেটাতে অনলাইনে সাহায্যের হাত পাতছেন ভারতীয়রা
সার্স কোভ-২ ভাইরাসের অতিসংক্রামক ডেল্টা ভেরিয়েন্টে নাভিশ্বাস উঠছে বাংলাদেশের জনজীবনে। কিন্তু, এটি প্রথম আঘাত হেনেছিল প্রতিবেশী ভারতে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যার দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও নজিরবিহীন চাপ সৃষ্টি করে সংক্রমণের রেকর্ড গতি। এসময় সরকারি হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অনেক মানুষ বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের দ্বারস্থ হন, যারা এখন বিপুল চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সাহায্যের ধর্না দিচ্ছেন অন্যদের কাছে।
চিকিৎসা সেবার বিল এত বেশি যে তার জন্য অনলাইনে ক্রাউডফান্ডিং বা গণ-তহবিল যোগাড় করতে হচ্ছে তাদের।
মহামারির দ্বিতীয় তরঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুপ্রাজা রেড্ডি ইয়েরুভা নামের এক ২৭ বছরের নারী। দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থাতেই গত জুনে তার মধ্যে কোভিডের লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। আর সন্তান জন্মদানের দিন চারেক পর ফুসফুসে সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করলে নিশ্বাস নিতেও পারছিলেন না তিনি। জীবন বাঁচাতে স্ত্রীকে হায়দরাবাদ শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ'তে ভর্তি করান তার স্বামী বিজয় ইয়েরুভা।
সুপ্রাজা এখনও সেই হাসপাতালেই আছেন, আর এযাত্রায় জীবন বাঁচলেও চিকিৎসার খরচ মেটাতে নিরুপায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি। সদ্যজাত শিশু আর ছয় বছরের বড় মেয়েকে দেখাশোনা করছেন তাদের বাবা বিজয় আর প্রতিনিয়ত স্ত্রীর দ্রুত আরোগ্য চাইছেন।
শুধু সন্তানদের জন্য নয়, বরং সংগতির কারণেও উদ্বিগ্ন বিজয়। এরমধ্যেই তার হাতে প্রায় ৬০ লাখ রুপির বিল ধরিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, প্রতিদিন যা আরও বাড়ছে।
স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে এরমধ্যেই নিজের স্বাস্থ্য বিমার টাকা খরচ হয়ে গেছে তার। পেড়িয়ে গেছে ক্রেডিট কার্ডের ব্যয়সীমা, ফুরিয়েছে ব্যাংক ঋণের টাকাও। সব উৎস হারিয়ে ৩৫ বছরের যুবা বিজয় এখন কেট্টু নামের একটি অনলাইন ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্মের দ্বারস্থ হয়েছেন।
মাসে তিন হাজার বেশি ডলার আয়কারী বিজয় জানান, সাহায্যের জন্য এভাবে হাত পাতার কথা তিনি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি।
"পরিবারের চাহিদা মেটাতে সব সময় কঠোর শ্রম দিয়েছি, কোনোদিন কারো কাছে সাহায্য চাইনি। তহবিল যোগাড়ের কথা এখনও মানুষের কাছে বলতে লজ্জা পাই।"
কিন্তু, বিজয় একা নন, তার মতো হাজার হাজার কোভিড রোগীর পরিবার-পরিজন এখন ভারত জুড়ে। সর্বনাশা দ্বিতীয় ঢেউ চলে গেলেও যার আর্থ-সামাজিক মাশুল গুণে চলেছেন তারা। ঘাড়ে নতুন আপদ; পর্বতপ্রমাণ মেডিকেল বিল।
তাই দেনা মেটাতে মানুষের ভিড় বাড়ছে অনলাইনে গণ-তহবিল যোগাড়ের চেষ্টায়। এমনকি এর গতি এতটাই বেশি যে তা অনেকের জন্য স্বাস্থ্য বিমা বা সরকারি সাহায্যের বিকল্প হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি চলাকালে ভারতের সবচেয়ে বড় তিনটি ক্রাউডফান্ডিং ওয়েবসাইট- কেট্টু, মিলাপ ও গিভ ইন্ডিয়ার ২৭ লাখ দানকারী মিলে অভাবগ্রস্ত মানুষকে মোট ১৬ কোটি ডলারের বেশি সাহায্য দিয়েছেন।
কেট্টুতে তহবিল যোগাড়ের আবেদন করেছিলেন বিজয় ইয়েরুভাও। তিনি জানান, মহামারির দুই ঢেউ চলাকালে সাইটটিতে মোট ১২ হাজার কোভিড রিলিফ ক্যাম্পেইন পরিচালিত হয়, যার মাধ্যমে তহবিল আবেদনকারীদের মোট ৪ কোটি ডলার দিয়েছেন সহৃদয় দাতারা।
অনলাইনের গণ-তহবিল সংগ্রহ নিয়ে লেখা বই ক্রাউডফান্ডিং: দ্য স্টোরি অব দ্য পিপল- এর যৌথ দুই লেখক রাভিনা বাঞ্জে ও ইরফান বশির বলেন, "অনেক ক্ষেত্রেই এটি এখন বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঘাটতি পূরণে ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের একটি বিকল্প উৎস হয়ে উঠেছে।
মহামারি হানা দেওয়ার আগেই ক্রাউডফান্ডিয়ের সাহায্য নেওয়ার মতো বিপদে পড়েছেন ভারতের লাখ লাখ মানুষ।
কারণ, সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অপ্রতুল সক্ষমতায় বেসরকারি চিকিৎসা খাত আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে, নতুন বিনিয়োগে গঠিত হয় জমকালো অনেক বেসরকারি হাসপাতাল। কিন্তু, একইসাথে বেড়ে চলা খরচ মানুষের সাধ্যের অতীত হয়ে পড়তে থাকে।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল এবং পাবলিক হেলথ ফাইন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার (পিএইচএফআই) তথ্যানুসারে, শুধুমাত্র ২০১১-১২ অর্থবছরেই ব্যয়বহুল চিকিৎসা খরচের কারণে দরিদ্রের খাতায় নাম লেখান ৩৮ লাখ মানুষ।
তবে চলতি মহামারিতে চিকিৎসা দেনার প্রভাবে কত মানুষ সর্বশান্ত হয়েছেন তা নিয়ে এখনও কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি। যদিও ডিউজ গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউট এবং পিএইচএফআই- এর প্রাথমিক একটি গবেষণা বলছে, ভারতে স্বকর্মসংস্থানে জড়িত জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ এবং বেতনভোগী কর্মীদের অন্তত অর্ধেক জরুরি চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য হারিয়েছেন।
আয়কারী মানুষের যখন এ করুণ হাল, তখন ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কী দশা- সেটা সহজেই অনুমেয়। তাদের ওপর আসা বিশাল ব্যয়ের চাপ তুলে ধরে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানাচ্ছেন, গত বছর চিকিৎসা ব্যয় পূরণে অক্ষম দরিদ্রের সংখ্যা আরও ২৩ কোটি বেড়েছে। এদের অন্তত ৯০ শতাংশ দেনা মেটাতে গড়ে ২০১ ডলার ধার করেছেন। অর্থাৎ, তাদের মোট দেনার বোঝা বেড়েই চলেছে, হ্রাস পাচ্ছে সামাজিকভাবে বন্ধু ও পরিজনের থেকে ধার নেওয়া সম্ভাবনা।
তার সঙ্গে স্বাস্থ্যখাতে ভারত সরকারের সীমিত ব্যয়ের প্রভাব তো আছেই। দেশটি মোট জিডিপির মাত্র ১.২ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবায় ব্যয় করে, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম কম। এমনকি দুই-তৃতীয়াংশ ভারতীয় নাগরিকের জন্য নেই কোনো স্বাস্থ্য বিমা। সমাজের সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীগুলোর চিত্র আরও মানবেতর।
এব্যাপারে লেখক বশির বলেন, "জরুরিচিকিৎসার দরকার বলে-কয়ে আসে না, যেকোনো মুহূর্তে তা দরকার হতে পারে। কিন্তু, সিংহভাগ জনগণ যখন আর্থিক অস্থিতিশীলতার চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন গুজরান করছে- তখন এ দরকার এক ভয়াবহ দুর্ভোগ ও দুর্যোগের আবহ সৃষ্টি করতে পারে।"
অথচ, ২০১৮ সালেই ভারতের দরিদ্রতম ৫০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যের স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এসময় ভারত সরকারের চালু করা 'মোদি কেয়ার' নামক প্রকল্পটি বিশ্বের বৃহত্তম স্বাস্থ্য বিমার উদ্যোগ হিসেবে পরিচিতি পায়।
তবে মহাসমারোহের প্রচার-প্রচারণার পর কাজের কাজ হয়েছে সামান্যই। প্রক্সিমা কনসাল্টিং নামক একটি সংস্থার বিশ্লেষণে জানা গেছে, মোদি কেয়ারে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তাদের মাত্র ১৩ শতাংশ কোভিড আক্রান্ত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির পর বিমা দাবি করতে পেরেছেন, বা অর্থ পেয়েছেন।
তবে এই বিমার আওতায় হাসপাতালের বহির্বিভাগের খরচ যেমন; বিভিন্ন রকম টেস্ট ও থেরাপির বিল রাখা হয়নি। যদিও মেডিকেল বিলের সবচেয়ে বড় অংশ এসব খরচ।
নাগপুর শহরের বাসিন্দা তরুণী চিন্ময় হিয়াওয়াসে তার বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতার শিকার হন। প্রথমে ৫৭ বছরের বাবা রাজেশের জন্য অক্সিজেন ও খালি শয্যা যোগাড়ে হিমশিম খেয়েছেন।
অনেক চেষ্টার পর শয্যা মেলায় ভেবেছিলেন এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারবেন কিন্তু তখনই এমআরআই স্ক্যানে রাজেশ অটো-ইমিউন ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত বলা জানা যায়। সঙ্গে তার দেহে মিউকরমাইকোশিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণও ধরা পড়ে।
এসব রোগের অতিরিক্ত চিকিৎসা হিসেবে রোগীকে প্রতিদিন ৯৪ ডলার মূল্যের ইঞ্জেকশন দিতে হয়েছে। সবশেষে বিল দাঁড়ায় ৩৩,৬৩৩ মার্কিন ডলার।
২৫ বছরের ওই তরুণী বিল দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। বাবার অবর্তমানে পরিবারের একমাত্র আয়কারী চিন্ময় কিছুদিন আগেই স্নাতক পাস করে চাকরি করছেন এবং পিতামাতার একমাত্র সন্তান। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি, সে কথা স্মরণ করে বলেন, "বিল দেখেই স্তম্ভিত হয়ে যাই, মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।"
তাছাড়া সঞ্চয় বলেও তেমন কিছুই ছিল না রাজেশের। বেসরকারি একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেছে চাকরি করে তিনি মাসে মাত্র ৬০৫ ডলার সমপরিমাণ আয় করতেন, ভারতীয় মুদ্রায় যা ৪৫ হাজার রুপি। স্বাস্থ্য বিমা না থাকায় সামান্য যা কিছু সঞ্চয় করেছিলেন তা তাঁর মেডিকেল বিল দিতেই শেষ হয়ে যায়। তারপরও হাত পাততে হয় বন্ধু ও স্বজনদের কাছে।
সেটাও যথেষ্ট না হওয়ায় অনলাইনে তহবিল সংগ্রহে নামে পরিবারটি। এপর্যন্ত পরিবারটি প্রায় ৯ লাখ রুপি অনুদান যোগাড় করতে পেরেছে; তারা যে পরিমাণ চাহিদার কথা দাতাদের সামনে তুলে ধরেছিল, প্রাপ্ত অর্থ তার প্রায় অর্ধেক।
চিন্ময় হিয়াওয়াসে বলেন, মানুষের দান আমাদের একটু স্বস্তি এনে দিয়েছে। ক্রাউডফান্ডিং এত ভালোভাবে সাহায্য করে কোনদিন বুঝিনি।"
লেখক রাভিনা বাঞ্জে বলেন, "বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য যাদের নেই, তাদেরকেও এটি সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।"
বেশিরভাগ দাতাই হলেন তহবিল আবেদনকারী রোগী বা তাঁর পরিবারের বন্ধু ও পরিচিত জন। কিন্তু, এর বাইরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অনেক এনজিও, সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ অপরিচিত বহু হৃদয়বান মানুষ। ভারতের বাইরে অন্যান্য দেশে বসবাসকারী প্রবাসীরাও দায়িত্ব অনুভব করেই এমন দান করছেন।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দান পাচ্ছে সবচেয়ে করুণ চিত্র তুলে ধরা তহবিলের ক্যাম্পেইনগুলো। আবার যেসব রোগীদের সামাজিক মাধ্যমের নেটওয়ার্কিং ভালো তারাও এগিয়ে আছে।
রাভিনা বাঞ্জে ও ইরফান বশির আশঙ্কা প্রকাশ করেন, দানকারীদের এই চর্চায় এমন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে যেখানে শুধু গুরুতর রোগীরাই সাহায্য পাচ্ছেন। কিন্তু, দক্ষতাও এখানে একটি বিষয়। অনেকে ঠিক মতো নিজের দুর্দশার কথা তুলে ধরতে জানেন না, এবং তাদের আবেদন উপযুক্ত সাড়া পাচ্ছে না।
লেখকদ্বয় বলেন, "সবাই তো ভালো গল্প বলিয়ে নন, আবার সবচেয়ে করুণ গল্পটিও অনেকের নয়। কিন্তু তাই বলে তাদের জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন অবহেলা করার সুযোগ নেই।"
তাছাড়া, ভারতের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় না থাকায় ক্রাউডফান্ডিং 'তথ্যগত বৈষম্য' তৈরি করতে পারে। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত জনসংখ্যা এ পরিসরের সুযোগ গ্রহণ করতে না পারার কারণেই যা সৃষ্টি হচ্ছে।
- সূত্র: বিবিসি