চট্টগ্রাম-গজারিয়া রুট জাহাজ চলাচলের এক বিপদজনক সমুদ্র চ্যানেল
চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গর থেকে পণ্য নেওয়ার পথে চট্টগ্রাম চর গজারিয়া রুটের ১১৪ কিলোমিটার এলাকায় গত ৬ বছরে ডুবেছে শতাধিক লাইটার জাহাজ ও বাল্ক হেড।
ডুবে যাওয়া জাহাজের প্রায় ২৫ ভাগ উদ্ধার না হওয়ায় বন্দর চ্যনেল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন এই রুটে চলাচলকারী জাহাজের মাস্টাররা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম চরগজারিয়া রুটে সবচেয়ে বেশি জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ভাসানচর এলাকায়। চ্যানেলের গতিপথ পরিবর্তন, ডুবোচর, অবৈধ বাল্কহেডে পণ্য পরিবহন, ডুবে যাওয়া জাহাজে মার্কিং না থাকা, নির্দেশনা না মানাকে জাহাজ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের এ পর্যন্ত ৮ টি জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে বেসরকারি লাইটার জাহাজ পরিচালনা সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রাণাধীন ২৯টি জাহাজ ডুবেছে। চট্টগ্রাম চর গজারিয়া রুটে বাল্কহেড ডুবেছে প্রায় ৪০টি। এই সময়ে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে প্রায় ২৫টি।
চট্টগ্রাম বন্দরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মাদার ভেসেলে (বাল্ক ক্যারিয়ার) আমদানি হওয়া পণ্য যেমন খাদ্য শষ্য, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্যাপ, পাথর, বর্হিনোঙ্গরে খালাসের পর সেগুলো অভ্যন্তরীন নৌ রুটে পরিবহন করা হয়। সারা দেশে ৫ হাজার লাইটার জাহাজ চলাচল করে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন নৌ রুটে চলাচল করে ২ হাজার জাহাজ। যার বেশিরভাগই বেসরকারি জাহাজ পরিচলানাকারী সংস্থা ওয়ারটার ট্রান্সপোর্ট সেল নিযন্ত্রন করে। এই রুট ব্যবহার করে অন্যান্য নৌ রুটে দেশের বিভিন্ন স্থাণে পণ্য পরিবহন করে লাইটার জাহাজগুলো।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে পণ্য নিয়ে চলাচলকারী লাইটার জাহাজের ড্রাফট ৩ থেকে ৫ মিটার। চট্টগ্রাম চরগজারিয়া ভায়া ভাসানচর ১১৪ কিলোমিটার দুরত্বের এই রুটে গভীরতা ৩.৯৬ মিটার। এই রুটের বয়ারচর এলাকায় সর্বনিম্ন গভীরতা ২.৯০ মিটার।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে পণ্য নিয়ে ১৪ বছর ধরে জাহাজ পরিচালনা করা এমভি শোভন জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, "বেশিরভাগ লাইটার জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হাতিয়ার ভাসানচর এলাকায়। সাগরের দুই দিকে একসাথে জোয়ারের পানি চাপ দেওয়ায় জাহাজের নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।"
"তার উপর আছে বিআইডব্লিওটিএ'র নানা অব্যবস্থাপনা। এই এলাকায় কোনো জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বিআইডব্লিওটিএ থেকে মার্কিং করা হয়না। ফলে চলাচলের সময় ডুবে যাওয়া জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে একই স্থানে আবারও দুর্ঘটনা ঘটে," বলেন তিনি।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম চর গজারিয়া রুটে পূর্বে ভাসানচর এবং ঠেঙ্গার চরের মাঝামাঝি পথ দিয়ে জাহাজ চলাচাল করতো। সেখানে পলি জমে যাওয়ায় দুই চরের বাম পাশ দিয়ে দুই চরের বাম পাশ দিয়ে নতুন চ্যানেল চিহ্নিত করা হয়। এই চ্যানেলে গত বছরের নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে ড্রেজিং করা হয়।
তবে, জোয়ার-ভাটার কারণে ড্রেজিং করলেও সেখানে পুণরায় পলি জমে যায়। ভাটার সময় এই চ্যানেলে সাড়ে ৩ মিটার গভীরতা থাকে। তাই জোয়ারের সময় এই পথে জাহাজ চলতে হয়।
বিআইডব্লিওটিসির সহকারি পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, চট্টগ্রাম চরগজারিয়া রুটে হাতিয়ার বয়ারচর এলাকায় সর্বশেষ হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ মতে চ্যানেল পরিবর্তন হওয়ায় বয়ারচর বয়াটি বর্তমানে চ্যানেলের মধ্যে অবস্থান করছে। তাই বয়াটির উভয় পাশ দিয়ে সতর্কতার সাথে চলাচল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "ভাসানচর এলাকায় সাগরের গভীরতা কম থাকায় জোয়ারের ২ ঘণ্টা পর পাড়ি দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু জাহাজের মাস্টাররা সেই নির্দেশনা মানে না।পর্যাপ্ত পথ নির্দেশক বয়াও দেওয়া হয়েছে।"
"এছাড়া সাগরে ৩ নম্বর সংকেত জারি হলে লাইটার জাহাজ পরিচালনা বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু জাহাজ মালিক কিংবা মাস্টাররা এই নির্দেশনা মানেনা। ফলে জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে," যোগ করেন তিনি।
এই রুটে ২২ বছর ধরে জাহাজ পরিচালনাকারী এমভি তাজ উদ্দিন জাহাজের মাস্টার মো: আবু তাহের বলেন, "আজ থেকে ৬ বছর আগে এই রুটে চলাচলের সময় ভাসানচর এবং ঠেঙ্গার চরের মাঝামাঝি পথ দিয়ে জাহাজ চলাচল করতো। সমুদ্রের গভীরতা কমে যাওয়ায় ৬ বছর ধরে রুট পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে ভাসানচর এবং ঠেঙ্গারচরের বাম পাশ দিয়ে জাহাজ চলাচল করছে। এর ফলে প্রায় ৯ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব বেড়ে গেছে। সময় লাগে অতিরিক্ত ২ ঘণ্টা।"
তিনি আরও বলেন, "নতুন রুটেও আছে ভয়ানক বিপদ। এই রুটের দুই পাশেই আছে ডুবো চর। একটু ভুল করে জাহাজ ডানে বা বামে গেলে জাহাজ আটকে যাওয়া কিংবা দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে। অন্যদিকে এই রুটে টানা ৫ ঘণ্টা স্রোত ডিঙ্গিয়ে চলাচল করতে অনেক জাহাজের মাস্টার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।"
ভাসানচর এলাকায় কেন বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস (এমএমও) এর প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, "চ্যানেলে পর্যাপ্ত মার্কিং না করা, ডুবে যাওয়া জাহাজে মার্কিং না দেওয়া, মার্কিং রক্ষণাবেক্ষণ না করা, প্রয়োজনীয় সার্কুলার না দেওয়া, অদক্ষ মাস্টার দ্বারা জাহাজ পরিচালনা, সাগরের সিগন্যাল অমান্য করে জাহাজ চালানোসহ বিভিন্ন কারণে জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে।"
তিনি আরও বলেন, "অভ্যন্তরীন লাইসেন্স পাওয়া জাহাজগুলো সাগরে চলাচলের উপযোগী নয়। এভাবে চলতে থাকলে চট্টগ্রাম বন্দর এবং বর্হিনোঙ্গর ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। উপকূলীয় এলাকায় চলাচলের জন্য নির্মিত জাহাজ ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির নিয়ম অনুযায়ী নির্মাণ করার বাধ্যবাধকতা আছে। অভ্যন্তরীন জাহাজের নির্মাণের ক্ষেত্রে তেমন বাধ্যবাধকতা নেই। ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির নিয়ম অনুযায়ী জাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে ৬০ ভাগ ব্যয় বৃদ্ধি হওয়ার কারণে অভ্যন্তরীন জাহাজের সনদ নিয়ে করে সেগুলো কোস্টাল এলাকায় পরিচালনা করছে জাহাজ মালিকরা।"
এদিকে ওভার লোড, ফিটনেস বিহীন জাহাজ, সগরে সিগনাল অমান্য করে জাহাজ পরিচালনা করাকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত হলেই লাইটার জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ হলেও মালিকদের চাপে মাস্টাররা জাহাজ চালাতে বাধ্য হন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো: ইছা মিয়া।
২০২০ সালের ১৫ আগস্ট সাগরে ৩ নম্বর সিগনাল থাকা অবস্থায় জাহাজ পরিচালানার কারণে হাতিয়া এলাকায় এমভি আকতার বানু এবং এমভি সিটি ১৪ নামের দুইটি পণ্যবাহী লাইটার জাহাজ সাগরে ডুবে যায়।
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "একটি জাহাজ ডুবে গেলে জাহাজের আকার ভেদে পণ্য সহ ৫ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারে সরকারি কোনো উদ্যোগ থাকেনা। ডুবে থাকা জাহাজের ধাক্কায় চলাচলকারী লাইটার জাহাজ দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েও জাহাজ পরিচলনায় বাধ্য হচ্ছি আমরা। সরকারিভাবে সন্দীপ চ্যানেলে ড্রেজিং করা গেলে জাহাজ দুর্ঘটনা কমানো যাবে।"
কিছু নাবিক সমুদ্রে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত জারির পরও জাহাজ পরিচালনা করে স্বীকার করে নুরুল হক বলেন, এ কাজে মালিকরা তাদের বাধ্য করেনা। তবে, ফিটনেসবিহীন জাহাজ চলাচলের অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
এদিকে বালু উত্তোলনের জন্য স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত বাল্কহেডের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গর থেকে পণ্য পরিবহন করছে একটি চক্র। সাগর পথে পরিচালনায় অদক্ষ নাবিক দিয়ে এসব বাল্কহেড বন্দর চ্যানেল এলাকা, নোয়াখালীর ভাসানচর সহ বিভিন্ন নৌ রুটে দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। প্রায় ২ শতাধিক বাল্কহেডের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের কারণে লাইটার জাহাজগুলোও দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে চলে জানিয়েছে লাইটার জাহাজের নাবিক এবং মালিকরা।
গত ৩০ এপ্রিল সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ডুবে যায় এমভি পিংকি নামের পাথরবোঝাই একটি বাল্কহেড। ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পর এটি ভাসতে ভাসতে একটি বড় বাণিজ্যিক জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তলিয়ে যায়। বাল্কহেডের পাঁচ ক্রুকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এর আগে ২ মার্চ কর্ণফুলী নদীর কালারপুল এলাকায় ডুবে যায় পাথরবোঝাই আরও একটি বাল্কহেড।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম বলেন, "বাল্কহেডে শুধু বালু পরিবহন হওযার কথা। অথচ একটি চক্র অবৈধভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে পণ্য নিয়ে সাগর পথে বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব বাল্কহেডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানাও করেছে। এরপরও বন্ধ হয়নি বাল্কহেড মালিকদের তৎপরতা।"