ক্রমাগত লকডাউনে নিম্ন আয়ের মানুষের তিন বেলার আহারে টান
করোনা ও লকডাউনের কারণে টান পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের তিন বেলার খাবারে। আয় হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়া এই মানুষগুলো এখন অনাহার ও অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। আমিষের প্রধান উৎস মাছ বা মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন এই শ্রেণির মানুষ। এমনকি অনেকে নিয়মিত ডিমও খেতে পারছে না। কেউ কেউ দিনে মাত্র একবেলা খাচ্ছেন।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি বস্তি ঘুরে ও বিভিন্ন পেশার নিম্ন-আয়ের মানুষের সাথে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেল।
কারওয়ান বাজারে তোয়ালে ও ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা হকার আলম হোসেন গত মঙ্গলবার মাত্র একবেলা খেয়েছেন। পরদিন বুধবার দুপুর পর্যন্ত ছিলেন অনাহারে।
লকডাউনের বাকী দিনগুলো কিভাবে কাটবে, সে চিন্তায় মলিন তার চেহারা। কারণ যানবাহন বন্ধ থাকায় রাস্তায় তার বিক্রির সম্ভাবনা নেই। নতুন করে অন্যকিছু নিয়ে হকারি করার সামর্থ্যও নেই তার।
"রাস্তায় জ্যামে পড়া মানুষের কাছে ফুল-তোয়ালে বিক্রি করে দৈনিক ২০০-৩০০ টাকা আয় হতো। লকডাউনে গাড়ি বন্ধ থাকায় আয় নেই। হাতেও কোনো টাকা নেই। কেউ সাহায্যও করছে না। স্ত্রীকে-সন্তান নিয়ে ঠিক মতো একবেলাও এখন পেট ভরে খেতে পারি না," বলেন আলম।
"মাংস কেনা তো দূরে থাক, ছেলে-মেয়ের মুখে মাসে একবার মাছও তুলে দিতে পারছি না এখন", যোগ করেন ছয় সন্তানের এই বাবা।
এদিকে শারীরিক প্রতিবন্ধী ছয় সন্তানের বাবা বাদশা মিয়া হাঁটা-চলা করতে অক্ষম হওয়ায় কোন কাজ করতে পারেন না। প্রায় ২৩ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসে কারওয়ান বাজারে ফুটপাতে চা-সিগারেট বিক্রি করতে শুরু করেন। বার বার লকডাউনে তার বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। গত তিন দিন তার ঘরের হাঁড়িতে আগুন জ্বলাও বন্ধ ছিল বলে জানান তিনি। লকডাউনে বাধ্য হয়ে তাই রাস্তায় ভিক্ষা করতে নেমেছেন।
"চার মাসের ২৪০০০ টাকা বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে পারি নাই, বার বার সময় চেয়ে নিচ্ছি। যখন চা-সিগারেট বিক্রি করতাম তখন তিন বেলাই খেতে পারতাম, এখন শুধু দুপুরে এক বেলা খাই, ভিক্ষা করে কিছু পাইলে বিকাল বেলায় বাচ্চাদের মাঝে মধ্যে বিস্কুট কিনে দেই"।
"এখন আমার কাছে আর চাল নেই, টাকা পয়সাও নেই। প্রথম লকডাউনে বিভিন্ন মানুষ এসে কিছু খাবার দিয়ে যেত। এবার সেটাও পাচ্ছি না"।
স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে এক বস্তিতে থাকা মো. মিরাজ বলেন, "তিন বছরের সন্তানকে দুধ কিনে খাওয়াবো সেই টাকা নেই। আলু ভর্তা, ডাল ভাত খেয়ে চলছে দিন। কখনও এক বেলা, কখনও দুই বেলা ভাত খেতে পারছি। করোনার মধ্যে ধার করেছি ৪০ হাজার টাকা"।
বেকার হয়ে পড়া এই নির্মাণ শ্রমিক আরও বলেন, "ছয় মাস আগে একবার মাছ কিনেছিলাম। সরকার থেকে কোন সহায়তা পাচ্ছিনা আমরা। এমন চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে"।
রংমিস্ত্রি ইব্রাহিম খলিল বলেন, "করোনার আগে প্রতিদিন কাজ থাকতো। সে সময় সপ্তাহে দুই দিন মাছ, মাসে একদিন গোশত কিনতে পারতাম। এখন শাক, আলু, ডাল দিয়ে ভাত খেয়েই চলে"।
করোনার প্রকোপ আসার আগে আরামবাগ গার্লস স্কুলে চাকরি করতেন রাশেদা আক্তার। তবে বর্তমানে শাজাহানপুরের এক রাস্তার পাশে চা-সিগারেটের দোকান দিয়ে কোন রকমে ৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে বস্তিতে থাকেন।
"আয় খুবই কম। মাছ-মাংস কেনা তো দূরে থাক, ঠিকমত ডিমও কিনতে পারি না। মাঝে মাঝে বাজারে ভাঙ্গা ডিম বিক্রি করে সেইগুলো নেই", বলেন রাশেদা।
"১৬ বছর আগে স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। পরিবার আমার একার আয়েই চলে। কোন রকম বেঁচে আছি। দুই মাসের ঘর ভাড়ার ১২০০০ টাকা বাকি পড়েছে। সরকার কোন ধরনের সহযোগিতাও করে নাই", যোগ করেন অসহায় এই নারী।
ফুচকা বিক্রেতা মোহাম্মদ জাকির বলেন, "আয় কমে গেছে, কোনরকম পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে চলছি। আগের মত বাজার করতে পারিনা তাই খাওয়াও কমে গেছে। আলু ভর্তা-ডাল ভাত চলে এখন। আর মাঝে মাঝে বাজার থেকে কম দামে ভাঙ্গা ডিম পেলে কিনি"।
"সর্বশেষ রোযার ঈদের আগে একদিন মাছ কিনেছিলাম। কোন সহযোগিতা পাই না। একটি এনজিও থেকে ৪০০০০ টাকা ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ১০০০০ টাকা ধার নিয়েছিলাম ব্যবসাটাকে একটু বড় করব। কিন্তু লকডাউনের কারণে তাও করতে পারছি না।"
এদিকে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করলেও নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারছেন না।
মোহাম্মদ এরশাদ আগে প্রাইভেট কার চালাতেন, বর্তমানে ফল বিক্রি করেন। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন রেলওয়ে কলোনি বস্তিতে।
"আমার আয় অনেক কমে গেছে তাই স্বাভাবিকভাবে আমার খাবারও কমে গেছে। কষ্ট করে হলেও এখনো তিন বেলা খাবার চালু রাখতে পেরেছি। তবে সবজি দিয়েই বেশি খেতে হচ্ছে। মাছ-মাংস জুটছে না", বলেন এরশাদ।
এরশাদের মতই আরেক জন ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন। তিনি গুলিস্তানে মোবাইল এক্সেসরিজের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা চলে না তাই এখন খিলগাঁওয়ে ফল বিক্রি করেন।
"কোন রকম খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। কিছু টাকা জমানো ছিল সেগুলো শেষ করে ফেলেছি এই কয় দিনে। সামনে কি হবে কিছুই বুঝতে পারছি না"।
আব্দুল গফুর কয়েক মাস আগেও খিলগাঁও রেলগেট বাজারে কনজুমার প্রোডাক্টস-এর পাইকারি বিক্রেতা ছিলেন। একের পর এক লকডাউনের কারণে তিনি বিভিন্ন সময় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হন। তাই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। সংসার চালাতে এই লকডাউনে সবজি বিক্রি করতে নেমেছেন।
একইভাবে বাসের হেলপার, ড্রাইভার, ভ্যান চালক, হকার, নির্মাণ শ্রমিক, দিনমজুর, গৃহকর্মী, চা বিক্রেতা সহ বিশাল সংখ্যার নিম্ন আয়ের মানুষ পেট ভরে খেতে পারছেন না।
"গত এক বছর মাছ কিনি না। সবজি ও ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছি", বলেন কল্যানপুর বস্তিতে থাকা মমতাজ। তিনি ও তার স্বামী ভ্যানে করে ভাঙ্গারি কিনে বিক্রি করেন।
"করোনা আসার পর কাজ নেই হাতে। আমরা দিন আনি দিন খাই। গতকাল জুতা সেলাই করে ৮০ টাকা আয় করেছি, সেই টাকা দিয়ে চাল ডাল কিনেছি", কথাগুলো বলেন মিরপুর-১ এ মুচির কাজ করা অনিল দাশ।
"এক বছর আগে দুধ খেয়েছি। সন্তানরা বলেছিল, বাবা, একটু আম দুধ খাব, তাই এক কেজি আম ও দুধ কিনেছি", বলেন অনিল।
এদিকে ৩১শে মার্চ থেকে ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত দেশব্যাপী ব্র্যাকের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই এবং আগের তুলনায় চরম দারিদ্র্যের হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ।
দিনমজুর মোহাম্মদ ফারুক বলেন, "কাজ নাই। পাঁচ সদস্য নিয়ে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। বাসায় প্রায়ই বাজার থাকে না। অল্প অল্প করে দুইবেলা খাই। মাছ-মাংস কবে কিনেছি তাতো ভুলেই গেছি। সবজি কিনতেই টাকা শেষ হয়ে যায়"।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "করোনায় প্রায় এক কোটি নিম্ন আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এভাবে লকডাউন চলতে থাকলে এর সংখ্যা দিন দিন বাড়বেই। সরকারের উচিত এ সমস্ত ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তত ১ কোটি লোককে মোবাইল সেবার মাধ্যমে কমপক্ষে ১২ মাস দুই হাজার টাকা করে প্রণোদনা দিয়ে বেঁচে থাকতে সহায়তা করা"।