চট্টগ্রামে ৮ বছরে জাহাজ ভাঙা শিল্পখাতে ১০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ভোগ্যপণ্য, ইস্পাত, পোশাক, কৃষি, আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে এ ঋণ সুবিধা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে এই ঋণের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি হয়েছে ইস্পাত ও জাহাজ ভাঙা শিল্পখাতে।
শিপ ব্রেকিং বা জাহাজ ভাঙা খাতের রমরমা ব্যবসার সময় অনভিজ্ঞ ও নতুন ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যাচাই-বাছাই না করে সহজে ঋণ প্রদান ও অন্যান্য ব্যবসা থেকে আসা অনভিজ্ঞ উদ্যোক্তারাই শিল্পটিকে অস্থির করে তুলেছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাত্র আট বছরেই (২০১৩-২০২০) ইস্পাত খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বছর বছর ঋণের বোঝা বাড়লেও গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ইস্পাত খাত থেকে অনেক ব্যবসায়ী ছিটকে পড়ায় এই পাওনা আদায়ে দুঃশ্চিন্তায় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ইস্পাত খাতে বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগ করা অর্থের মধ্যে সর্বশেষ গত এক বছরেই ৪৭৩ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে। চট্টগ্রামের ইস্পাত শিল্পের ১৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই খেলাপি ঋণ আদায়ে এরই মধ্যে আদালতে দারস্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
এর আগের সাত বছর অর্থাৎ ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালে পর্যন্ত এই খাতের ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল নয় হাজার ৪২১ টাকা। সেই হিসেবে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইস্পাত খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপির পরিমাণ নয় হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শিপ ব্রেকিং খাতে ভালো ব্যবসার সময় অনেক অনভিজ্ঞ লোকজন এই খাতে ব্যবসা শুরু করে। ব্যাংকগুলোও নামমাত্র এসব প্রতিষ্ঠানকে উদার হস্তে ঋণ প্রদান করে। পরবর্তীতে আর্ন্তজাতিক ও দেশীয় বাজারে স্ক্র্যাপ ও ইস্পাতের দামের উত্থান-পতনে অনভিজ্ঞরা মাঠ ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেই সময় দেওয়া ব্যাংক ঋণের বোঝা এবং দুর্নাম এখনো বইতে হচ্ছে এই খাতের ব্যবসায়ীদের।"
শিপ ব্রেকিং খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে শিপ ব্রেকিং খাতে রমরমা ব্যবসা হয়। ওই সময় নতুন নতুন ব্যবসায়ী এই খাতে ব্যবসায় নামেন। নতুন পুরানো সব ব্যবসায়ীকে উদার হস্তে ঋণ প্রদান করে ব্যাংকগুলো।
মূলত বার্ষিক লক্ষ্য পূরণে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে এই খাতে ঋণ প্রদান করে। সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে ব্যবসায়ীরা ব্যবসার পাশাপাশি জমি ক্রয় ও ভোগ বিলাসে এই টাকা বিনিয়োগ করেন।
কিন্তু ২০১৩ সালে দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে ইস্পাতের কাঁচামালের বড় দরপতনে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয় এই খাতের ব্যবসায়ীদের। ওই সময় আর্ন্তজাতিক বাজার থেকে ৭৬০ ডলারে প্রতি টন স্ক্র্যাপ কিনে তা দেশীয় বাজারে ২২০ ডলারে বিক্রির ঘটনা ঘটে।
ওই সময় নতুন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনে বাজার থেকে উধাও হয়ে যান। শুধু নতুন ব্যবসায়ী নয়, বহু পুরানো ব্যবসায়ী এই সময় লোকসান গুনলে খেলাপির খাতায় তাদের নাম ওঠে। এরপর ২০১৩ সালের পর থেকে ব্যাংক ঋণ শোধ করতে না পেরে বছর বছর খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণও।
খেলাপি ঋণের তালিকায় পুরানো নাম করা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি যোগ হয়েছে নতুন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানও। এরমধ্যে পেনিনসুলা স্টিলের কাছে ওয়ান ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ২৫০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, এস স্টিল এন্টারপ্রাইজের কাছে পদ্মা ব্যাংকের ৪৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা, রায়হান মেটালের কাছে ওয়ান ব্যাংকের ৩৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, আর এম স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৪ কোটি ২০ লাখ টাকা, প্রিমিয়ার স্টিলের কাছে ইস্টার্ন ব্যাংকের ১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে মামলা হয়েছে।
আগে খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গত বছর আলী স্টিলের কাছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৭৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা, ফরচুন স্টিলের কাছে সোশাল ইসলামী ব্যাংকের ১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা এবং শাহ আমানত আয়রন মার্টের কাছে চার কোটি টাকা পাওনা আদায়ে মামলা হয়েছে।
এছাড়া নতুন খেলাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মদিনা আইরন মার্ট, এনডিআর স্টিল, চট্টলা আয়রন মার্ট, যমুনা স্টিল করপোরেশন, খাজা আজমির আয়রন মার্টের নাম যোগ হয়েছে গেল বছরে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট পাওনাদার ব্যাংক গত বছর আদালতে মামলা দায়ের করে।
ইস্পাত খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে
ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শিপ ব্রেকিং ও ইস্পাত খাতের চাঙ্গা বাজারে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরাও এই পেশায় নাম লেখান। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও কোন ধরণের বাছ-বিচার না করে এই খাতের উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করে। সেই অর্থায়নেরই বড় অংশ এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে।
আদালতের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গত আট বছরে আদালতে অর্থঋণ সংক্রান্ত মামলা দায়ের বেড়েছে। এই আট বছরে ইস্পাত খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা।
এরমধ্যে গত বছর ২০২০ সালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে প্রায় ৪৭৩ কোটি টাকা আদায়ে মামলা করেছে পাওনাদার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর আগে ২০১৯ সালে ৫০০ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে তিন হাজার ১২৯ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে চার হাজার ২১৯ কোটি টাকা ২০১৫ সালে এক হাজার ৩৪৮ কোটি, ২০১৪ সালে দুই হাজার ২১০ কোটি ও ২০১৩ সালে পাঁচ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা পাওনা আদায়ে মামলা করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
ঋণ খেলাপিদের তালিকাও লম্বা
ইস্পাত শিল্পে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ রয়েছে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর রাইজিং স্টিলের কাছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের বর্তমান খেলাপি দুই হাজার ৫৯১ কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের বড় খেলাপি প্রতিষ্ঠান মিশম্যাক গ্রুপের বেশিরভাগ ঋণ নেওয়া হয়েছে ইস্পাত খাতে বিনিয়োগের নামে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে কয়েকটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
ইস্পাত খাতের অপর প্রতিষ্ঠান ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের নামে পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকার বেশি। রুবাইয়া গ্রুপের আড়াই হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের ৯০০ কোটি টাকায় র্নেওয়া হয়েছে ইস্পাত খাতে।
স্টিল খাতে সম্প্রতি আড়াই হাজার কোটি টাকার ঋণ আটকে যাওয়া আরএসআরএমে'র কাছে দুই ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণে এক হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা।
ব্যবসায়িক কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই ইস্পাত খাতে ব্যবসায় নেমে প্রায় ২০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে সীতাকুন্ডের মো. সিরাজুদ্দৌল্লার। তার প্রতিষ্ঠান পাকিজা এন্টারপ্রাইজের নামে এই ঋণ রয়েছে।
গেল বছরে (২০২০সালে) শিপ ব্রেকিং খাতে ১৫ টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে খেলাপি মামলা হয়েছে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে। এর আগের বছর ২০১৯ সালে মামলার পরিমাণ ছিল ১৪টি। ২০১৮ সালে শিপ ব্রেকিং ও ইস্পাত খাতে ২১টি ও ২০১৭ সালে ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে খেলাপি মামলা দায়ের করে বিভিন্ন পাওনাদার ব্যাংক। এর আগের চার বছর অর্থাৎ ২০১৩-১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খাতের ৫৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ছিল প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক জাহেদ ইকবাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শিপ ব্রেকিং ও ইস্পাত খাতে এত বেশি ঋণ খেলাপি হওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তারাও কম দায়ী নয়। কারণ ওই সময় গ্রাহকের ক্রেডিট নিড এসেসমেন্ট কিংবা রিস্ক অ্যানালাইসিস না করেই ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ঋণ প্রদানে ছিল ব্যাংক কর্মকর্তাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বেশিরভাগ গ্রাহক সহজে ঋণ পেয়ে ব্যবসার পরিবর্তে জমি ক্রয়, ভোগ বিলাস কিংবা বিদেশে পাচার করেছে। ২০০৮-২০১২ সালে ইস্পাত ও শিপ ব্রেকিং খাতে প্রদান করা ঋণের বোঝা এখনো টানতে হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। "
এছাড়া মাহিন এন্টারপ্রাইজের ৯৩৫ কোটি টাকা, শাহ আমানত আয়রন মার্টের ৬০০ কোটি টাকা, মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ৫২৯ কোটি টাকা, এহসান গ্রুপের এহসান স্টিলের ৪৮৪ কোটি টাকা, আম্বিয়া স্টিলের ৩০০ কোটি টাকা, এসকে স্টিলের ৩১৪ কোটি টাকা, পেনিনসুলা স্টিলের ৩০০ কোটি টাকা, সুপার সিক্স স্টারের ১৫০ কোটি টাকা, বেঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিজ ১৪০ কোটি টাকা, ক্রিস্টাল স্টিল এন্ড শিপ ব্রেকিংয়ের ১৩৫ কোটি টাকা, মোস্তফা গ্রুপের মোস্তফা স্টিলের ১২৫ কোটি টাকা, জিলানি ট্রেডার্সের ১০৮ কোটি টাকা, হিলভিউ শিপ ব্রেকিংয়ের ৮৩ কোটি টাকা, জিকে স্টিলের ৭৫ কোটি টাকা, তানহা স্টিলের ৭১ কোটি টাকা, রাশেদ আয়রন স্টিলের ৬৫ কোটি টাকা, আরাফাত স্টিলে ৬০ কোটি টাকা, ফরচুন শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজে ৫৩ কোটি টাকা, শাহেদ শিপ ব্রেকিংয়ের ৪৪ কোটি টাকা, এসএম স্টিলের ৪৩ কোটি টাকা, জয়নাল স্টিলের কাছে ৩৬ কোটি টাকা, একে এন্টারপ্রাইজের ৩৬ কোটি টাকা, সাকিব স্টিলের কাছে ৩৩ কোটি টাকা, ইউনিক স্টিলে ২৬ কোটি টাকা, সুলতানা শিপ ব্রেকিংয়ের ১৯ কোটি টাকা, খাজা আজমির শিপ ব্রেকিংয়ের ১১ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে।