আগস্টের দশ দিনেই বছরের প্রায় অর্ধেক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি
চলতি বছর জুড়ে মোট যতজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন- তাদের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক ভর্তি হয়েছেন চলতি আগস্টের প্রথম ১০ দিনে। ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, যা গত মাসেও ছিল অনেক কম।
এদিকে রাজধানীতে মোট ডেঙ্গু রোগীর প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হলেও; দক্ষিণ মহানগর কর্তৃপক্ষ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অভিযানের নামে ভবন মালিকদের জরিমানা করা হলেও- নেই নিয়মিত পরিদর্শন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অভিযান চালিয়ে আর জরিমানা করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মূল বাধা হিসেবে সিটি কর্পোরেশনের পেশাদারিত্বের এবং জনসম্পৃক্ততার অভাবকে দায়ী করছেন তারা।
দেশে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এবং করোনা ও ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রায় একই থাকায়; টেস্ট না করিয়ে অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন নিজেদের বাসা-বাড়িতে। যে কারণে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়াও অনেকটা দূষ্কর। আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন শিশুরা। এই অবস্থায় ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডেঙ্গুর এ অবস্থার জন্য সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞবৃন্দ এবং নগরবাসী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, আজ মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২২৬ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এবছর আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯৭৮ জনে। আর চিকিৎসা শেষে এবছর হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ৪,০৪৬ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে চলতি মাসের ১০ দিনেই ভর্তি হয়েছেন- ২,৩২১ জন ডেঙ্গু রোগী যা পুরো বছরে আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক, আর গত মাসের থেকেও বেশি। জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২,২৮৬ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন।
বর্তমানে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালের তথ্যানুযায়ী, এ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৮৫২ জন এবং রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী। এ সংখ্যা গত মাসের ২৫ তারিখের আগেও ছিল ১০ জনের নিচে।
আর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ১৮ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রেরিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন, জুলাই মাসে ২,২৮৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সারাদেশে মোট এক হাজার ৪০৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। যাদের মধ্যে সাত জন মারা যান।
২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির অতিক্রম করে। সে বছর দেশে প্রায় ১,০১,৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সন্দেহে আইইডিসিআর-এ ২৭৬ জনের মৃত্যুর তথ্য জমা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনায়, তাদের মধ্যে ১৭৯ জনের ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
৮০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়:
ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের লক্ষ্যে মশক নিধনে চিরুনি অভিযান ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও- এর তেমন কোনো সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। প্রতিদিনই ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে বিভিন্ন ভবন ও বাসাবাড়ির মালিকদের জরিমানা হয় কয়েক লাখ টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) দাবি করছে, ঢাকার ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ রোগী উত্তরের। আর ২৭ জুলাই থেকে উত্তর সিটিতে চলমান চিরুনি অভিযানে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ৪৮,৯৯,৭০০ টাকা জরিমানা আদায় করে।
আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ৭৯,১০,৬০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে মশা নিধনের বিভিন্ন অভিযানে।
মশা মারতে ডিএনসিসি চলতি বছরের বাজেটে বরাদ্দ রেখেছে ৭২ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২ কোটি টাকা বেশি।
ডিএসসিসির মশকনিধনে গত বছরের তুলনায় এ বছর বাজেটে বরাদ্দ কমেছে। গত অর্থবছরে মশকনিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি টাকা। সে বছর খরচ হয়েছে ৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
মঙ্গলবার ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে বলেন, "ডিএনসিসি এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা রাজধানীর মোট আক্রান্তের মাত্র ২০ শতাংশ হলেও- তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। নিজেদের বাসাবাড়িতে ফুলের টব, অব্যবহৃত টায়ার, ডাবের খোসা, চিপসের খোলা প্যাকেট, বিভিন্ন ধরনের খোলা পাত্র, ছাদ কিংবা অন্য কোথাও যাতে তিন দিনের বেশি পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।"
মেয়র আতিক আরও বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে জমা দেয়া প্রতিটি অব্যবহৃত কমোড ও টায়ারের জন্য ৫০ টাকা এবং প্রতিটি ডাবের খোসা, রংয়ের কৌটা ও চিপসের প্যাকেটের জন্য ৫ টাকা হারে আর্থিক পুরষ্কার প্রদান করা হবে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এডিস মশার আধিক্য এবং কতৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন- এ বিষয়ে ডিএসসিসি'র জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাসের টিবিএসকে বলেন, "আমাদের কন্ট্রোল রুম থেকে নিয়মিত এডিস মশা নিধনে কাজ করে যাচ্ছি। সাথে সাথে অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে। আপাতত রোগীর সংখ্যা কত শতাংশ এমন তথ্যের দিকে খেয়াল না দিয়ে মশা নিধনেই মনোনিবেশ করেছে দক্ষিণ সিটি।"
ডেঙ্গু সারা দেশে আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ড. বে–নজির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "ডেঙ্গুর সংক্রামণ বাড়ার সাথে নগরায়নের একটা যোগসূত্র রয়েছে। নগরায়ন বেড়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ব্যবহৃত নানান ডিনিসপত্র পড়ে থাকার কারণে সেখানে পানি জমে এডিস মশার জন্ম নেয়- সেটাই ঘটছে আমাদের দেশে। এখন গ্রামাঞ্চলেও এগুলো বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হওয়াটাই স্বাভাবিক।"
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পেশাদারিত্ব ও জনসম্পৃক্ততার অভাব রয়েছে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, "কোনো এলাকায় একদিন গিয়ে ঘুরে এসে জরিমানা করে ডেঙ্গুর সংক্রামণ রোধ করা সম্ভব না। ঐসব এলাকায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এজন্য যেমন প্রশিক্ষিত জনবল দরকার তেমনি দরকার গবেষনাও। সাথে সাথে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে কয়েক গুণ।"
তিনি আরও বলেন, "এ কার্যক্রম একেবারেই যৎসামান্য। সমুদ্র থেকে ২/৪ চামচ পানি তুললে যেমন সমুদ্রে কোনো প্রভাব পড়ে না, তেমনি এভাবে লোক দেখানো অভিযান আর জরিমানাও খুব বেশি কাজে আসবে না।"