দশ মাস ধরে পড়ে আছে আইসিইউ বেড!
দেশে প্রতিদিনই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ এর অভাবে মারা যাচ্ছেন বহু করোনা রোগী আর সেই সংকট কাটাতেই পাঁচটি আইসিইউ এবং ১২টি হাই ডেপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) স্থাপন করা হয়েছিল ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু আইসিইউ স্থাপনের দশ মাস পেরিয়ে গেলেও আজও এগুলো চালু হয়নি।
গত বছরের অক্টোবর মাসে আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছিল এখানে। আর এ বছরের এপ্রিলে ১২টি হাই ডেপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) বসানো হয় হাসপাতালটিতে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) পরিচালিত পুরান ঢাকার নয়াবাজার এলাকার ১৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি গত বছর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোভিড রোগীদের সেবা দিলেও করোনার এ সংকটময় সময়ে সেখানে প্রায় এগারো মাস ধরে বন্ধ আছে করোনা চিকিৎসা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ হাসপাতালটির তদারকির ভার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের উপরে ন্যাস্ত করা হয়েছে কিন্তু মিটফোর্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে হাসপাতালটিতে লোকবল নিয়োগ কিংবা নতুন সেবা চালু বা বন্ধ করার বিষয়ে তাদের কোনো হাত নেই।
সাধারণ রোগীদের কাছে এ হাসপাতালটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল বলে পরিচিত থাকায় এবং এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতির সংকট থাকায় সাধারণ রোগীও তেমন আসছে না বলে ধারণা করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পর্যাপ্ত লোকবল সংকট এবং কোভিড-নন কোভিড দোদুল্যমান থাকায় চিকিৎসার এ সংকট তৈরী হয়েছে বলে ধারণা তাদের।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আইসিইউ ও এইচডিইউ চালু করতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে আগস্টের ৯ তারিখ পর্যন্ত মোট ৭ বার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, যে কারণে এই সংকটের সময়েও আইসিইউগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, গত সপ্তাহে সিটি কর্পোরেশন থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে যে হাসপাতালটিতে লোকবল প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকায় আপাতত সেখানে সাধারণ চিকিৎসা দেওয়া হবে এবং পরবর্তিতে পর্যাপ্ত লোকবল হলে তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কোভিড হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার হবে কিনা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার করোনা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তখন ৩০ জন চিকিৎসক, ৩৫ জন নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে মোট ৯০ জনকে পদায়ন করা হয়েছিল।
আর বর্তমানে হাসপাতালের নিজস্ব জনবল রয়েছে মাত্র ৭৩ জন। এর মধ্যে চিকিৎসক ১৫ জন, নার্স ১১ জন। এ বছরের মার্চ থেকে দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে করোনা রোগীদের জন্য ১১০টি শয্যা প্রস্তুত করে রাখা হলেও এসব শয্যায় এখনও কোনো সাধারণ কিংবা কোভিড রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে না।
হাসপাতালটিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকে এ হাসপাতালে আউটডোরে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে এখানে রোগীর থেকে করোনা টিকা দিতে আসা মানুষের উপস্থিতিই বেশি। দশ মাস ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা আইসিইউ বেডগুলো নিয়মিত ঝেড়েমুছে রাখেন পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। এছাড়া এইচডিইউ এর ভেতরে বেডগুলোর উপরে জমে আছে ধুলার প্রলেপ।
সাধারণ বেড ও কেবিনগুলো ঘুরে দেখা যায় প্রায় ১২০টি বেডই পড়ে আছে অব্যবহৃত অবস্থায়। অনেকগুলো বেড নষ্ট হয়ে যাওয়ার পথে। বেডের উপরে জমে আছে ধুলা বালুর আস্তরণ।
হাসপাতালের দেওয়া তথ্যমতে, ৯ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত মাত্র একজন রোগী ভর্তি হয়েছে। আর হাসপাতালে মোট ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন মাত্র ২৪ জন রোগী।
হাসপাতালটির একজন নার্স টিবিএসকে বলেন, "করোনা রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ হওয়ার পর থেকে এখানে সাধারণ রোগী একেবারেই কম। একদিকে আমাদের লোকবল সংকট আবার এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে অনেকেই আগ্রহী নয়। যারা আসেন তাদের আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি"।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অর্গানোগ্রাম (জনবল কাঠামো) অনুযায়ী, ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে জনবল থাকার কথা ১৬৬ জন। কিন্তু বর্তমানে আছেন মাত্র ৭৩ জন। যেখানে চিকিৎসকই থাকার কথা ৩১ জন সেখানে ডাইরেক্টর অফিসের মেডিকেল অফিসারসহ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১৫ জন এবং ৩৭ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ১১ জন। এদের মধ্যে ৬ জনই কাজ করছেন কোভিড এর টিকাদানে।
নতুন করে আইসিইউ স্থাপন করা হলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা অপারেটরের জন্য নেই কোনো লোকবল। আধুনিক একটি অপারেশন থিয়েটার থাকলেও নেই কোনো সার্জন বিশেষজ্ঞ। অপারেশন থিয়েটারে শুধু সিজারই করা হয়।
ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রকাশ চন্দ্র রায় টিবিএসকে বলেন, "আমরা করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় সামগ্রিকভাবে স্বল্প জনবল নিয়েও সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং এতে সফলও হয়েছে। আমাদের প্রায় ৫০০ ভর্তি রোগীর মধ্যে মাত্র চারজন রোগী মারা গিয়েছিলেন। পরর্তীতে আমরা ৬/৭ বার জনবলের চাহিদা দেওয়ার পরও অধিদপ্তর থেকে কোনো সাড়া পাইনি"।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রয়োজনীয় জনবল পেতে বেশ কয়েকবার আবেদন করার পরেও আমরা জনবল পাইনি। এখন সরকার করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু ফিল্ড হাসপাতাল করায় ওখানে নতুন করে জনবল নিয়োগ দেওয়ায় আপাতত মহানগর হাসপাতালটিতে নতুন করে জনবল নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনা কম তাই এ হাসপাতালটিতে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা চলমান থাকবে"।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "উত্তর সিটির করোনা হাসপাতালে লোকবলসহ চিকিৎসা চালু আছে আর সেটা অনেক ভালোই চলছে এর কারণ ঐ হাসপাতালটি স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের কাছে থাকা দেশের কোনো হাসপাতালই ভালো চলছে না মহানগর হাসপাতালটিও এর ব্যতিক্রম নয়"।
তিনি আরও বলেন, "আইসিইউ স্থাপনের দশ মাস পার হয়ে গেলেও তা চালু করতে না পারা দায়িত্বহীনতা। এ হাসপাতালে অন্য কোথাও থেকে লোকবল এসেও থাকতে চায় না। এ জন্য হাসপাতালটি স্বাস্থ্য বিভাগের নিকট হস্তান্তর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাতে যদি সেবার মান ভালো হয়"।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা টিবিএসকে বলেন, "ঢাকা মহানগর হাসপাতালের লোকবলের বিষয়টি এবং এর সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়টি তদারক করার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা নিজেরা সমন্বয় করে কোভিড ও নন-কোভিড সব ধরনের রোগীদেরই সেবা দিবেন"।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশীদ উন নবী টিবিএসকে বলেন, "যেহেতু মহানগর জেনারেল হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন নয় সেহেতু এখানকার কার্যক্রমে আমাদের তদারকি করতে নির্দেশনা দেওয়া আছে কিন্তু এখানকার লোকবল নিয়োগের বিষয়টি আমাদের হাতে না। আমরা শুধু অর্থ আর চিকিৎসার বিষয়গুলো দেখভাল করি। নতুন জনবল নিয়োগ এবং এখানে কি চিকিৎসা হবে সেটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিষয়"।