আফগান যুদ্ধ হওয়া কি জরুরি ছিল?
২০০১ সালে আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পন করতে প্রস্তুত ছিল তালেবান। কিন্তু, দুর্বল তালেবানের সেই শান্তিচুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সময়ের পরিক্রমায় আজ ২০ বছর পর পুরোপুরি উল্টে গেছে পাশার দান।
৯/১১ হামলার পর তালেবান যোদ্ধারা কালাশনিকভ উঁচিয়ে বিজয় উদযাপন করে। ওসামা বিন লাদেনকে তুলে দেওয়া না হলে যুক্তরাষ্ট্র বোমা হামলা চালানোর হুমকি দিলেও প্রথমদিকে তা কানে তোলেনি তালেবান।
কিন্তু, আমেরিকা বোমা নিক্ষেপ করতে শুরু করলে কমতে থাকে তাদের তর্জন। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাবুল ছেড়ে তালেবান সদস্যরা পালাতে শুরু করে। প্রতিরোধ ক্ষমতাও হারাতে থাকে তারা।
আফগানিস্তানের ধু ধু পাহাড়ের মাঝে পালিয়ে বেড়ায় তালেবান যোদ্ধারা। যুদ্ধের শুরুর দিকের প্রতিবেদন সংগ্রহকারী এক সাংবাদিকের মতে, সেসময় তালেবান অনিশ্চয়তায় ডুবে যায়। নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারায় তারা।
২০০১ সালের নভেম্বরে নিরুপায় হয়েই হামিদ কারজাইয়ের কাছে ছুটে যায় তালেবানের শীর্ষ নেতারা। এর কিছুদিন পরেই কারজাই আফগানিস্তানের অন্তবর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান। তারা কারজাইয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ধি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
সেসময় আফগানিস্তানে জাতিসংঘের রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে কর্মরত বারনেট রুবিন বলেন, "তালেবান তখন চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখোমুখি, সাধারণ ক্ষমা ছাড়া তাদের আর কোনো দাবি ছিল না"।
তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সদরদপ্তর থেকে হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হতে থাকে। হামিদ কারজাই তালেবানের আত্মসমর্পন চেয়েছিলেন। চূড়ান্ত আত্মসমর্পনের পর ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর কোনো সক্রিয় ভূমিকা থাকবে না বলে আশাবাদী ছিলেন তিনি।
কিন্তু, ওয়াশিংটন তখন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। তারা চিরতরে তালেবানকে নিশ্চিহ্ন করতে আগ্রহী। কোনো সমঝোতা চুক্তিতে যাওয়ার ইচ্ছা তাদের ছিল না।
মোল্লা ওমরকে ছেড়ে দিতে আগ্রহী ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। জীবিত অথবা মৃত যেকোনো অবস্থায় তাকে ধরতে উদগ্রীব ছিল এই পরাশক্তি।
প্রায় ২০ বছর পর আফগান যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে ঠিকই সমঝোতা চুক্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, ততদিনে তালেবানের ক্ষমতার পাল্লা ভারি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তি করলে দীর্ঘ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মিশন পরিচালনাকারী কূটনীতিকদের জন্য তা বিশ্বাসঘাতকতার সামিল হয়ে দাঁড়ায়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ক্ষমতায় এসে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বলবৎ রাখেন।
ক্ষমতা যখন আজ ফের তালেবানের দখলে, তখন এই কূটনীতিকদের অনেকেই পুরোনো প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। তালেবান আত্মসমর্পন করতে চাইলেও সেই সুযোগ হাতছাড়া করে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ, তখন তা মেনে নিলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের এই যুদ্ধ শুরুতেই থামানো যেত। যুদ্ধের মেয়াদও উল্লেখজনকভাবে কমে যেত। বেঁচে যেত লাখো প্রাণ।
তবে, বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, ২০০১ সালে তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো পরিস্থিতিই ছিল না।
জেনারেল জোসেফ ডানফোর্ডের সিনিয়র পরামর্শদাতা কার্টার মালকাসিয়ান বলেন, "তালেবানের সমঝোতার আহ্বান ফিরিয়ে দিয়ে আমরা ভুল করেছিলাম। ২০০১ সালে ভীষণভাবে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম তালেবান পিছু হটেছে, তাদের আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। আমাদের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল, তাই আমরা এমন অনেক ভুল করেছি যা থামানো যেত।"
ট্রাম্প প্রশাসন যখন তালেবানের সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করে তখন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ নিয়ে ক্লান্ত। আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে প্রায় আড়াই হাজার আমেরিকান প্রাণ দিয়েছেন। যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো মিত্রদেশগুলোর অন্তত এক হাজার সেনা যুদ্ধে প্রাণ হারান।
আফগানদের মধ্যে এই মৃত্যুর সংখ্যা আরও ভয়াবহ। বেসামরিক নাগরিকসহ অন্তত দুই লাখ ৪০ হাজার আফগান যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। কয়েকটি, সূত্রানুসারে যুদ্ধে আমেরিকান করদাতারা প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন।
এদিকে, তালেবান কূটনীতি ও সমঝোতায় আগের থেকে মনোযোগী হয়ে ওঠে। পাকিস্তান হয়ে ওঠে তাদের প্রধান সরবরাহকারী ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। আমেরিকান সৈন্যদের উপস্থিতি যখন তুঙ্গে তখনও তারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে নতুন সদস্য নিয়োগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। আফিম বাণিজ্যের মুনাফায় আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে শক্তি বৃদ্ধি করে তারা।
সময়ের সঙ্গে আফগানিস্তানের উল্লেখযোগ্য অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তারা। মাঝেমধ্যে শহরে হানা দিয়ে কয়েকদিন রাস্তাঘাটে সরব উপস্থিতির পর পুনরায় প্রান্তিক অঞ্চলে গা ঢাকা দিত যোদ্ধারা। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকে। কখনো কখনো সপ্তাহে তা একশ'ও ছাড়িয়ে যায়।
আফগানিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত রায়ান ক্রোকার বলেন, "আমি যখন শুনি যুক্তরাষ্ট্র আফগান সরকারকে ছাড়াই তালেবানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে, তখনই আমি এটাকে শান্তি চুক্তি নয় বরং আত্মসমর্পনের আলোচনা বলেছিলাম।"
"এখানে মূল বিষয় এই ছিল যে, আমরা পিছু হটব কিন্তু চলে যাওয়া অবধি তালেবান আমাদের গুলি করবে না। পরিবর্তে, আমাদের আর কিছু চাই না," বলেন তিনি।
ট্রাম্প প্রশাসন যে চুক্তি করে সেখানে নারী অধিকারের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের এতদিনের ব্যয়, এতগুলো প্রাণহানি কোনো কিছুর কথাই সেখানে আসেনি।
এটা কোনো শান্তি চুক্তি ছিল না। বরং, এখানে তালেবানের কাছ থেকে অস্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের ভবিষ্যতে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়। এমনকি সেই চুক্তির ভাষাও ছিল বিতর্কিত। চুক্তিপত্রে আল-কায়েদাকে 'জঙ্গিগোষ্ঠী' হিসেবে উল্লেখ করার বিষয়টি মেনে নিতে অস্বীকার করে তালেবান।
এখন তালেবান আবারও ক্ষমতায় ফিরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করা আফগানদের সন্ধান করছে তারা। বিক্ষোভগুলো কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। নারীদের সমাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও দেশের বেশ কিছু অংশে ঘরের বাইরে নারীদের কাজের সীমারেখা টেনে দেওয়া হচ্ছে।
মোট কথা, যুক্তরাষ্ট্র গত ২০ বছরে যা কিছু করার চেষ্টা করেছে তার সবই এক নিমেষে মুছে যাবে বলেই ধারণা।
আফগানিস্তানের অন্তর্বতী সরকারের সঙ্গে কাজ করা আমেরিকান কূটনীতিক জেমস ডোবিনস বলেন, "তালেবানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অসংখ্য আফগানই আত্মসমর্পন করেন। কিন্তু এরপর আমরা তাদের বাগরাম এবং গুয়ানতানামো কারাগারে পাঠাই। বিষয়টি ঠিক ছিল কি না, তা নিয়ে কখনো কোনো আলোচনা হয়নি।
"যুদ্ধ পরবর্তী আফগানিস্তানে তালেবান কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, এই ধারণা আমি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তাদের এতটাই পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে যে তারা কখনো ফিরতে পারবে না," বলেন তিনি।
পুরনো স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, "আমার জানা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারিনি।"
জয়েন চিফ অব স্টাফের সাবেক পরামর্শদাতা মালকাসিয়ান বলেন, "তালেবানের সমঝোতা করার চেষ্টা কতটুকু সত্যি ছিল তা স্পষ্ট নয়। যারা যোগাযোগ করেছিল তারা আদৌ মোল্লা ওমরের প্রতিনিধি ছিল কি না, তাও পরিষ্কার জানা যায় না।"
"কিন্তু, তারপরেও একজন তালেবানও যদি সমঝোতা করতে চায়, তাহলে আমরা তা কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।
যুদ্ধ শুরুর দিনগুলোতে তালেবান উদ্ধত রূপ থেকে কত দ্রুত নরম হয়ে যায় সেই চিত্র আমার এখনও মনে আছে। ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তারা কয়েকজন সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানায়। সেই দলে আমিও ছিলাম। দেশের নিয়ন্ত্রণ এখনও তাদের হাতে রয়েছে, তা প্রমাণ করতেই আমাদের ডাকা হয়েছিল।
কিন্তু, আসলে তাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছিল না এবং সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দখলে থাকা অঞ্চলগুলোও তাদের দখলে ছিল না। এমনকি আফগান সীমান্তের কাছে তারা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়েও শঙ্কিত ছিল।
পশ্চিমা বিরোধী জনতা যখন আমাদের গাড়িতে পাথর ছুড়ে, আমাদের উইন্ডশিল্ড ভেঙে দেয়, তখনও তারা তাদের আটকাতে অসমর্থ ছিল।
তিনদিন পরেই তারা আমাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের ঘুরতে দিলে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে না বলে ভয় পায় কর্তৃপক্ষ। তালেবানের কর্তৃত্ব ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল, তারা ছিল প্রায় শেষ অধ্যায়ে।
অন্তত সেসময় তা-ই মনে হয়েছিল।
আলিসা জে. রুবিন নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাবেক কাবুল ব্যুরো প্রধান। তিনি সাত বছর আফগানিস্তানে সংবাদ সংগ্রহ করেন। আফগান যুদ্ধের প্রতিবেদন সংগ্রহের জন্য তিনি সাংবাদিকতায় পুলিৎজার পুরষ্কার পান।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস