শ্রমিকের সড়ক অবরোধ, দায় কার
বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে প্রায়ই হঠাৎ শ্রমিকের সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে এবং এতে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে এ ধরণের ঘটনা ঘটে আসলেও এর পেছনে প্রকৃত অর্থে দায় কার, তা নিয়ে শ্রমিক, মালিকপক্ষ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কোন পক্ষই দায় নিতে রাজি হয়না।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যস্ত সময়ে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলশান-১ নম্বর চত্বরে হঠাৎ করেই শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করলে জনদুর্ভোগ চরমে উঠে। ঘন্টাখানেক পর শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করলেও পরবর্তী কয়েক ঘন্টাব্যাপী রাজধানীর বড় অংশে সড়কে এর রেশ থেকে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে শমসের রেজিয়া ফ্যাশনস নামে ওই কারখানার শ্রমিকদের বুধবার বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও মালিকপক্ষ কথা রাখেন নি। বৃহস্পতিবার তারা রাস্তায় নামেন এবং এরপর সমস্যার সমাধান বের হয়। শ্রমিক নেতাদের প্রশ্ন, মালিকপক্ষ আন্তরিক হলে এই সমস্যাটি এড়ানো যেত।
কেবল শমসের রেজিয়া ফ্যাশনসের ঘটনা নয়, এভাবে শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ না করা, শ্রমিক ছাঁটাই, ট্রেড ইউনিয়ন করতে বাধা কিংবা ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে নেতাদের টার্গেট করার মত অভিযোগে প্রায়ই শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে দেখা যায়। রাজধানীর গার্মেন্টস অধ্যুষিত মিরপুর, মালিবাগ, রামপুরা, উত্তরা ছাড়াও গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় এ ধরণের শ্রম অসন্তোষ ও এর জেরে সড়ক অবরোধের খবর পাওয়া যায়।
গত সপ্তাহে গাজীপুর এলাকার স্টাইলক্রাফট লিমিটেড নামে বেশ বড় একটি কারখানার দুই হাজারের মত শ্রমিক পাওনার দাবিতে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করে রাখে দুই দিন। গত দুই বছর ধরে কারখানাটিতে শ্রমিকের পাওনা নিয়ে অসন্তোষ চলছিলো। সর্বশেষ দুই মাস আগে পাওনা পরিশোধের বিষয়ে শ্রমিক, মালিক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলেও মালিকপক্ষ ওই সমঝোতা রক্ষা করেন নি বলে অভিযোগ উঠে। এরপর শ্র্রমিকরা বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করে। চলতি সপ্তাহে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এক ত্রিপক্ষীয় সভায় পরবর্তী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে শ্রমিকের পাওনার এই সমস্যা সমাধান করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে মালিকপক্ষ।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র হিসাবে, গত প্রায় ৬ মাসে সংগঠনটির সদস্যভুক্ত ৪২টিতে বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন কারণে ছোট-বড় সমস্যা হয়েছিলো, যার বেশিরভাগই সমাধান হয়ে গেছে।
তবে বিজিএমইএ'র বাইরে বিকেএমইএ ও এই দুই সংগঠনের বাইরে অন্যান্য গার্মেন্টস কারখানা মিলিয়ে আলোচ্য সময়ে প্রায় ১০০ কারখানায় শ্রম অসন্তোষের মত ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছেন শ্রমিক নেতারা।
শ্রমিক নেতা ওইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তার কাছে অন্তত ৩০টি কারখানার তালিকা রয়েছে, যেখানে পাওনা, শ্রমিক ছাঁটাই, ট্রেড ইউনিয়নে বাধা সৃষ্টি করাসহ বিভিন্ন কারণে শ্রম অসন্তোষ ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে।
এজন্য কারখানা মালিক, মধ্যম সারির ব্যবস্থাপনা ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদাসীনতা ও অবহেলাকে দায়ী করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি অন্তত ৮টি কারখানার নাম উল্লেখ করে সেখানে অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরেন।
অবশ্য শ্রমিকের এমন দাবির সঙ্গে একমত নন কারখানা মালিকরা। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সিনিয়র সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে একশ্রেণির শ্রমিক নেতা শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে রাস্তায় নামায়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রমিকরা শ্রম আইনের বিভিন্ন বিষয়ে সঠিকভাবে না জানা, যথাযথ ট্রেনিং না থাকা, সচেতনতার অভাবে দাবি আদায়ের সঠিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে রাস্তায় নেমে আসে।
অপর সংগঠন বিকেএমইএ'র সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, দুই একটি জায়গায় হয়তো শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ দাবির পেছনে থাকে তথাকথিক শ্রমিক নামধারী বিদেশের এজেন্ট, যারা এদেশের পোশাক খাতকে ধ্বংস করতে চায়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের ডিজি শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা শ্রমিকদের কারখানাতেই রাখার চেষ্টা করি। তবুও সড়কে নামলে বুঝিয়ে কারখানায় ফেরানো এবং শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হই। তাতেও সফল না হলে মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিই। তবে শ্রম অসন্তোষ অতীতের চেয়ে অনেক কমে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শ্রমিক নেতা কামরুল হাসানের অভিযোগ, এসব ক্ষেত্রে শ্রম মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ।
তবে এমন অভিযোগের সঙ্গে একমত নন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। টিবিএসকে তিনি বলেন, আমি নিজেই কোন ঘটনা জানলে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের ডেকে সমাধানে বসি। যারা এসব অভিযোগ দেয়, তারা কি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শ্রম বিভাগ (ডিওএল) বা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডাইফ) তে গিয়েছিলো? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এসব জায়গায় অভিযোগই দেয়নি।
দেশে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ'র সদস্যভুক্ত সচল কারখানার সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। এই দুটি সংগঠনের সদস্য বহির্ভূত কারখানাসহ রপ্তানির সঙ্গে প্রায় চার হাজার কারখানা জড়িত রয়েছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানান।
আর শিল্পাঞ্চল পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে পোশাক খাত ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে কারখানার সংখ্যা ৮২২৬টি। এর মধ্যে প্রায় ৯৭% কারখানা চালু রয়েছে। এ তালিকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন কারখানা অন্তর্ভুক্ত নেই।