কেন জরুরি অবস্থার মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কাকে একসময় দেখা হত ঔপনিবেশিক জাল ছিন্ন করে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে। তবে তারা যে বর্তমানে সে পথ থেকে অনেকটাই বিচ্যুত, দেশটির অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি দেখে তা সহজেই বলা যায়। কোভিডের ধকল কাটিয়ে যদিও প্রায় দেশেরই নাজেহাল অবস্থা তবে দ্বীপ দেশ শ্রীলঙ্কার অবস্থা আরও বেগতিক।
হটাৎ করেই চিনি, চাল, গুড়ো দুধ, রান্নার গ্যাসসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সংকট তৈরি হওয়ায় দাম বেড়ে যায় এসব পণ্যের, যার ফলে দেখা দেয় মুদ্রার ব্যাপক দরপতন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশটির রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসের আদেশে ৩০ আগষ্ট থেকেই অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থায় আছে গোটা দেশ। তবে সংবিধান অনুযায়ী তা আবার ১৪ দিনের মধ্যে ২২৫ আসনের সংসদে অনুমোদিত হওয়া লাগত। গত ৭ সেপ্টেম্বর অধ্যাদেশটি পাশও হয়ে যায় সংসদে ১৩২-৫১ ভোটে।
শ্রীলঙ্কার গত ৫০ বছরের ইতিহাসে জরুরি অবস্থা এবারই প্রথম নয়, মার্ক্সবাদীদের বিদ্রোহ আর তামিল সিংহলী জাতিগত বৈষম্যের ফলস্বরূপ দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের (১৯৮৩-২০০৯) দাবানলে বহু সময়ই জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে পার করেছে দেশটির জনগণ।
সেসব সময়ের স্মৃতি যে মোটেও সুখকর ছিল না তা এই জরুরি অবস্থা নিয়ে বিরোধীদের আশঙ্কায় আরো প্রবল হয়। তারা বলছে সরকার চাইলে জরুরি অবস্থায় না গিয়েও প্রচলিত আইনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে পারত। কারণ জরুরি অবস্থার ফাঁকফোকরে ভিন্ন মতের দমন-পীড়ন অসম্ভব কিছু নয়, যেখানে বিনা ওয়ারেন্টেই গ্রেফতার দেখানো যায়।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিরোধীদের দমনের জন্য নয় বরং কোভিড পরিস্থিতিতে প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য তাদের এই পথ বেছে নিতে হয়েছে যা কালোবাজারি, মজুদদারদের রুখতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘাটতি দেখা দেয়া দ্রব্যগুলোর সরবরাহ এবং নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকবে সরকারের কাছে যাতে এসবের দাম সাধারণের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে এবং মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়।
পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মজুদদারির মত অনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত পণ্য স্বল্পমূল্য ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়ার সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে একজন সাবেক জেনারেলের হাতে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের হঠাৎ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এত তৎপরতা দেখে মনে হতে পারে "ধান ভানতে শিবের গীত কেন", কারণ তাদের এই আপাত ছোট সংকট পুরো অর্থনীতি যে খাদের কিনারায় আছে তারই জানান দেয়। রাবণের দেশের অর্থনীতি বছরের শুরু থেকেই যে "রাবণের চিতায় জ্বলছে" তার প্রমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তীব্র বৈদেশিক মুদ্রা সংকট। রাজাপাকসে ভাইদের ২০১৯ এর নভেম্বরে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এবছরের জুলাই পর্যন্ত সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে নিচে নেমে ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি চলতি বছর শ্রীলঙ্কার মুদ্রার মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে আরো ৭ শতাংশ কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে রপ্তানি খাতে, আবার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আমদানি বাণিজ্য বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে থমকে আছে।
অবস্থা এতটা শোচনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, তাদের এখন সার্ক অঞ্চলের প্রতিবেশীদের কাছে বৈদেশিক ডলার ধারের জন্য ধর্না দিতে হচ্ছে। চীন, ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশও তার প্রায় ৪৫ বিলিয়নের রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যার মধ্যে আগষ্টের মাঝামাঝি এবং শেষের দিকে দুই ধাপে ১৫ কোটি ডলার ছাড় দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই অর্থনৈতিক মন্দার পিছনে সব মিলিয়ে মোটাদাগে ছোট বড় তিনটি বিষয়কে দায়ী করা যায়।
প্রথমেই বলতে হয় দ্বীপ দেশটির পর্যটন খাতের কথা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা দেশটিকে ব্রিটিশরা নাম দিয়েছিল জুয়েল অব দা ক্রাউন বলে। শ্রীলঙ্কার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অনেকটাই আসে এই খাত থেকে, ২০১৯ এ তাদের জিডিপির ১২.৬ শতাংশ এসেছিল পর্যটন শিল্প থেকে। সেই পর্যটনের এখন বেহাল দশা করোনা মহামারির সংক্রমণে, ফলে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন তারা এই সেক্টরে।
পরবর্তী ধাপের ভুলটি, শ্রীলঙ্কার বর্তমান যে সংকট তার সাথে আরো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে সম্পূর্ণ জৈব কৃষিভিত্তিক চাষাবাদে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন, সেই লক্ষ্যে এবছর থেকে সেখানে রাসায়নিক সারের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। টেকসই উন্নয়নের ধারণা থেকে চিন্তা করলে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত বটে এবং এতে করে রাসায়নিক সার আমদানি বাবদ বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাঁচানো যেত। তবে এর দ্রুত বাস্তবায়ন ঘটাতে গিয়ে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক ধস নেমেছে, যেহেতু সেখানকার কৃষকরা এই পদ্ধতির সাথে অভ্যস্ত নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চা ও মসলা খাত যেখানে তাদের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে।
ক্রমবিন্যাসে সবার শেষে আলোচিত হলেও শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের অনুঘটক আর ভবিষ্যতে সবচে বেশি ভোগান্তির কারণ যা হয়ে উঠবে তা হল বৈদেশিক ঋণের বোঝা। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, তাদের এ বছর ৩.৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কথা থাকলেও জুলাই পর্যন্ত হিসাবে তারা মাত্র ১.৩ বিলিয়ন ডলারই পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধে তারা মুদ্রা বিনিময় প্রক্রিয়ায় ছুটছে ঋণদাতা দেশগুলোর দিকে, নতুন ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি আছে জেনেও।
শ্রীলঙ্কার এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থার হয়ত অবসান হবে কোন এক সময়ে। তবে তাদের সার্বিক অগ্রগতি নির্ভর করবে ঋণ সংক্রান্ত এইসব উভয় সংকট তারা কীভাবে মোকাবিলা করবে আর তাদের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা তারা কীভাবে নিরসন করবে। দিনশেষে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার এই অর্থনৈতিক সংকট এবং জালে আটকে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা অন্যদের স্পষ্টই সতর্ক বার্তা দিয়ে যায়।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।