‘ঢাকায় প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাজার লোক ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন’
ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।
শনিবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত 'নগরীর মশা নিবারণে সমস্যা: টেকসই সমাধানের একটি রূপরেখা' র্শীষক সেমিনারে বক্তারা এ তথ্য দেন।
তবে এ ধরনের তথ্যকে বিভ্রন্তিকর বলছে সিটি করপোরেশন।
সেমিনারে সিজিএস চেয়ারম্যান এবং কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'দুই সিটি করপোরেশনের যেভাবে মশা নিয়ন্ত্রনে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, তা নিতে পারেনি কতৃপক্ষ। শুধু শুধু জনগণের দোহাই দিয়ে এডিস মশার সংক্রমণকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবীদদের যে অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন সে অঙ্গীকার রাখতে পারেনি। ঢাকার ডেঙ্গু সংক্রমণ কমতে কিংবা বাড়তে সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা নেই।'
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'এখন যে পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন, তার কমপক্ষে ২০ গুণ রোগী আছেন দেশে। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের ডেঙ্গু নিয়ে ল্যানসেটের করা এক গবেষণায় উঠে এসেছিল, দেশে যে পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, তাদের সংখ্যার ২০ থেকে ৪০ গুণ পর্যন্ত রোগী সংক্রমিত থাকেন। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে খুবই সামান্য সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'মশার প্রজননস্থল যেমন পরিস্কার করছে না দুই সিটি করপোরেশন, তেমনি এডাল্ট মশা মারতেও ব্যর্থ তারা। ফলে তাদের কোনো কর্মসূচি কাজে আসছে না।'
অপরদিকে কীটনাশকের ওপর দিন দিন শুল্ক বাড়ছে; ফলে মানুষ নিজেরাও পারছে না মশা মারতে। যেখানে কীটনাশকের ওপর শুল্ক কমানো উচিত, সেখানে বাড়ছে। ৯০% পর্যন্ত শুল্ক দিতে হচ্ছে। এছাড়া কীটনাশক আমদানি করতেও বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। মাঝে মধ্যে আমদানি বন্ধও থাকে।
সেমিনারে আইইডিসিআর-এর মেডিক্যাল ইনটোমলোজিস্ট এবং প্রাক্তন প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ইতিমধ্যে ২১ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশের জন্য এটা বিব্রতকর যে, গত ৫০ বছরেও মশা সমস্যার কোনো সন্তোষজনক সমাধান হয়নি। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে যথাযোগ্য জনবল সমস্যা। সিটি করপোরেশনের কোনো প্রশিক্ষিত জনবল নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সিটি করপোরেশনের গতানুগতিক পদ্ধতিতে মশা মরছে না। মশক নিবারণ কর্মকাণ্ডে আধুনিক কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় না। ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়া মহামারি প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানসম্মত কর্ম পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।'
নাগরিকদের বিলাসিতার কারণে বাড়ির আশপাশ, ফুলের টব নিয়মিত পরিষ্কার না করায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে উল্লেখ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'অন্যের ক্ষতির কথা না ভেবেই আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে। আমি সরকারকে বলেছিলাম মশারি দান করুন মানুষকে। এক কোটি মশারি গরিব মানুষকে দান করুন; কিন্তু তা শোনেনি।'
তিনি আরও বলেন, 'ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পরে এন্টিবায়োটিক মৃত্যু ডেকে আনে। কোনোভাবেই এন্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না। শুধুমাত্র নিয়মিত প্যারাসিটামল খেলেই অধিকাংশের ডেঙ্গু জ্বর ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে প্যারাসিটামলেরও অভাব দেখা যায়। দামও বাড়ছে দিন দিন। যাদেরকে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় বসানো হয়, তারা না জানে স্বাস্থ্য, না জানে চিকিৎসা।'
সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মোঃ নিজামুল হক ভূইয়া, এনবিআর'র সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জেষ্ঠ্য কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান, আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক ড. মাহমুদুর রহমান প্রমুখ।
বক্তারা স্থানীয় সরকারের অধীনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, 'আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে আমাদের কোনো মনিটরিং নেই। কেউ বলে উত্তরের মশা দক্ষিণে যায়, আবার কেউ বলে দক্ষিণের মশা উত্তরে যায়; কিন্তু বাস্তবে পুরো ঢাকাই মশায় একাকার হয়ে গিয়েছে।'
তবে এসব অভিযোগকে মনগড়া বলছে সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের দাবি, তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাসের টিবিএসকে বলেন, 'সিটি করপোরেশন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে বলেই ডেঙ্গু এখনো মহামারি পর্যয়ে যায়নি। কীটতত্ত্ববিদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায় না।'
দেশে তিন মাসেরও কম সময়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৫৯
দেশে করোনার প্রকোপ কমলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমেনি। এ বছর জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫৯ জন মারা গেছেন। আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, শনিবার সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৩২ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ বছর আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫,৪৬০ জনে। চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৪,২০৪ জন।
জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২,২৮৬ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। আগস্ট মাসে ভর্তি হন ৭,৬৯৮ জন এবং চলতি মাসের ১৮ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৫,১০৪ জন।
বর্তমানে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, এ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৯৯০ জন এবং রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২০৭ জন ডেঙ্গু রোগী।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন, জুলাই মাসে ২২৮৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সারা দেশে মোট ১,৪০৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে সাত জন মারা যান।
২০১৯ সালে দেশে প্রায় ১,০১,৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। আইইডিসিআর-এ ২৭৬ জনের মৃত্যুর তথ্য জমা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনায় তাদের মধ্যে ১৭৯ জনের ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।