মহামারিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশী কাথাঁ শিল্পে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোকসান
করোনা মহামারিতে বড় ধরণের ক্ষতিতে পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নকশী কাথাঁ শিল্প। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে এ খাতে বিক্রি কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ, বেচাকেনা না থাকায় এ খাতে প্রায় ৫০-৬০% শ্রমিক বর্তমানে কাজ হারিয়ে বেকার। স্বাভাবিক সময়ে বছরে টার্নওভার ১১০-১২০ কোটি টাকা হলেও গত বছর বিক্রি হয়েছে মাত্র ১০-১৫ কোটি টাকার পণ্য, সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
তাছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রণোদনার তালিকাভুক্ত হলেও কোন অর্থই পায়নি এ খাত। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, দোকান ভাড়া ও শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশী কাথাঁ এসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, জেলায় ৩০০টির মতো কারখানায় প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করে, যার মধ্যে ৯৫ শতাংশই নারী শ্রমিক। এ খাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৪ লাখ লোক জড়িত। স্বাভাবিক সময়ে বছরে আনুমানিক ৭ লাখ নকশি পণ্য উৎপাদিত হতো, কিন্ত করোনায় গত বছর উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৪০ হাজার পণ্য। উদ্যোক্তাদের প্রায় ৯০ শতাংশেরই ব্যাংক ঋণ রয়েছে, করোনার প্রভাবে পণ্যের চাহিদা না থাকায় উৎপাদিত পণ্যও দুই-তিন মাস অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এই খাতটি এসএমই ক্লাস্টারের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত কোন উদ্যোক্তাই সরকারঘোষিত প্রণোদনার অর্থ পায়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একজন আদিবা বুটিকস হাউজের মালিক রেজিনা আনোয়ার ২০০৯ সালে থেকে নকশী কাথাঁর সাথে জড়িত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউ মার্কেট এলাকায় শো-রুমে পাইকারি ও খুচরা নকশী কাথাঁ বিক্রি করেন তিনি।
রেজিনা আনোয়ার টিবিএসকে বলেন, "এরকম মন্দা আগে কখনো দেখিনি, স্বাভাবিক সময়ে আমার বছরে প্রায় ১৩০-১৫০ লাখ টাকার বিক্রি হতো। করোনায় বর্তমানে আমার বছরে ১৫ লাখ টাকাও ঠিক মতো বিক্রি হয়নি। আগে যে রকম সারাদেশ থেকে পণ্যের অর্ডার আসতো, এখন তার ১০-১৫ শতাংশ অর্ডারও ঠিক মতো আসে না; ব্যাংক ঋণ,দোকান ভাড়া ও শ্রমিকদের বেতন- এ সব মিলিয়ে এ ব্যবসায় টিকে থাকতে এখন হিমশিম খাচ্ছি"।
ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের আরেকজন রওশন আরা বিজলী। ছোট থেকেই রওশন আরার স্বপ্ন ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি অস্বচ্ছল নারীদের জন্য কিছু করার। ২০০২ সালে মাত্র ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে চালু করেন 'স্বপ্নপুরী নকশী কাথাঁঘর' তিনি। তিনি জেলায় একদম শুরুর দিকের চার-পাঁচজন উদ্যোক্তাদের একজন। শহরের শাহীবাগ এলাকায় একটি শো-রুম রয়েছে তার। ভাইরাস আসার আগে প্রায় ৫০০ নারীর উপার্জনের অবলম্বন ছিলেন তিনি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "করোনায় এ পর্যন্ত আমার প্রায় ১ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে বছরে আমি প্রায় ৭ হাজার নকশী পণ্য উৎপাদন করতাম, কিন্ত করোনায় পণ্যের চাহিদা না থাকায় এখন বছরে ৫০০-৬০০ পণ্যও উৎপাদন করতে পারি না"।
তিনি আরও বলেন, "করোনা আসার আগে আমার মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৫০০ কর্মী নকশি কাঁথার কাজ করত, বর্তমানে আমি ঠিকমতো ১০০ জনকেও কাজ দিতে পারি না, কাজের সন্ধানে অনেক দু:স্থ, অভাবী নারীশ্রমিক প্রতিদিনই আমার কাছে এসে কাজ না পেয়ে ফেরত যাচ্ছে"।
জানা যায়, কত সাল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নকশী কাঁথার কাজ শুরু হয় তার সঠিক সাল কারোরই জানা নাই। বর্তমানে জেলায় এ খাতে ৩০০ উদ্যোক্তা হলেও ২০১০ সালের আগে ৩০-৪০ জন উদ্যোক্তাও ছিল না। নকশি পণ্য উৎপাদন করেই বেকারত্ব লাঘব করছেন জেলার অধিকাংশ নারী, কিন্তু করোনা আসায় এখন তাদের প্রায় অর্ধেকের বেশি বেকার।
নকশী পণ্যের আরেকজন নারীকর্মী উর্মীতা বেগম (৪৩)। তিনি করোনা আসার আগে বিভিন্ন শো-রুম মালিক ও বড় বড় উদ্যোক্তাদের থেকে পণ্যপ্রতি চুক্তিতে কাজ নিয়ে নকশি পণ্য উৎপাদন করে সংসার চালাতেন।
টিবিএসকে উর্মীতা বলেন, "করোনার আসার আগে আমি মাসে অন্তত ৮-১০ হাজার টাকা আয় করতাম, আমার পরিবারের আয়ের একটি বড় অংশই আমার ছিল। আমার আয় থেকে বাবা-মা ও সন্তানের খরচ মেটাতে পারতাম। কিন্ত কোভিডের প্রভাবে এখন আমি বেকার বসে আছি, অনেকের কাছে কাজ চাচ্ছি কিন্ত বেচাকেনা না থাকায় শো-রুমের মালিকরাও কাজ দিতে পারছেন না"।
নকশী কাঁথার মূল উপাদান হলো পুরাতন কাপড় ও রঙবেরঙের সুতা। পুরোনো কাপড় কয়েক ভাঁজ করে চার ধার সেলাই করে আটকানো হয়। বয়নশিল্প ও সেলাইয়ের সমান দূরত্ব আনার জন্য প্রথমে বড় বড় ফোঁড় দিয়ে টাক দিয়ে নেয়া হয়। তারপর সেলাই করা হয়। পুরোনো শাড়ির পাড় থেকে নেয়া রঙিন সুতা অথবা রঙিন ফেটি সুতা দিয়ে কাঁথার মোটিফের কাজ করা হয়। প্রথমে কেন্দ্রীয় মোটিফের কাজ হয়, তারপর চারকোণায় সমধরনের নকশা বা মোটিফ সেলাই করে অলংকরণ করা হয়। এরপর খালি অংশগুলো ছোট ছোট নকশা বা জ্যামিতিক মোটিফ দিয়ে ভরাট করা হয়। সবশেষে বাকি থাকা জমিনের অংশ সাদা সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়। সাধারণত এই রীতিতেই কাঁথা তৈরি করা হয়ে থাকে।
তবে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশী কাঁথার ফোঁড়, কাঁথার পাড় ও নকশার গুণগত মান বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। এ এলাকার পাঁচ রকমের কাঁথা বেশ নামকরা- লহরী কাঁথা, সুজনী কাঁথা, লীক কাঁথা, কার্পেট কাঁথা ও ছোপটানা কাঁথা।
সাধারণত নকশী পণ্যগুলোর দাম সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে প্রচারের অভাবে এখনো চাপাঁইয়ের এসব নকশি পণ্য দেশের গন্ডি ছেড়ে বিদেশে সরাসরি রপ্তানি হয়নি।
চাঁপাই নকশী কাথাঁ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আফসানা খাতুন বলেন, "করোনার প্রভাবে এই উদীয়মান ব্যবসা ধসে গেছে, এ বছর তেমন বিক্রি হয়নি বললেই চলে। সরকারের পক্ষ থেকে এ খাতে কোন উদ্যোক্তা বা কর্মী প্রণোদনাই পায়নি। কর্মীদের বেতন, দোকান বা শো-রুম ভাড়া ও ব্যাংক ঋণ শোধ করার জন্য দিশেহারা এ খাতে এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা"।
চাঁপাই নকশী কাথাঁ এসোসিয়েশনের সভাপতি তাহারিমা বেগম টিবিএসকে বলেন, "সরকারের এখন উচিত এ গ্রামীণ শিল্পকে এখনই ধসের মধ্য থেকে টেনে তোলা, প্রণোদনার অর্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌছায় সেটার তদারকি করা, নকশী শিল্পের জন্য কম সুদে ও জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা এবং এসব পণ্যের বিপণনের জন্য দেশে-বিদেশে প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা করা"।
তিনি আরো বলেন, "এ খাত প্রায় নিজ উদ্যোগেই এ পর্যন্ত এসেছে। যদি সরকার এ খাতের দিকে নজর দেয় তাহলে আগামী ১০ বছরে এ খাতে প্রায় ১০-১২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান অনায়াসেই সম্ভব এবং এই শিল্প সারাদেশেও ছড়িয়ে পড়বে। এছাড়াও দেশের দুঃস্থ ও অসহায় , বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, বেকার প্রমুখ নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ সুগম হবে"।