করোনায় ব্যবসা বেড়েছে বৃহৎ শিল্প সেবা খাতে
কোডিভ-১৯ মহামারির মধ্যেও ভালো করেছে দেশের পণ্য ও সেবাখাতের প্রায় সব বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ২০২১ অর্থবছরে কসমেটিকস, টেলিকম থেকে শুরু করে সিগারেট, আবাসন, তেল-গ্যাস, ওষুধ, রড, সিমেন্ট, সিরামিকস, বেভারেজ, ব্যাংকিংসহ প্রায় সব খাত থেকে ডাবল ডিজিটের বেশি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
২০২১ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সিগারেট, টেলিকম, হাউজিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্যাংক, ফাস্ট-মুভিং ভোগ্যপণ্য, উৎপাদন, নির্মাণ ও অন্যান্য কিছু ব্যবসা থেকে রাজস্ব সংগ্রহে প্রায় ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পণ্য ও সেবা বিক্রির বিপরীতে ৫-১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট এবং পণ্যভেদে বিভিন্ন হারে সম্পূরক শুল্ক আহরণ করে সরকার। ব্যবসায়ীরা মাস শেষে ভ্যাট রিটার্নের মাধ্যমে এ রাজস্ব পরিশোধ করেন। আগের বছরের তুলনায় যে যত বেশি টাকার পণ্য-সেবা বিক্রি করেন, তিনি তত বেশি রাজস্ব পরিশোধ করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভালো লজিস্টিক সাপোর্ট এবং ভোক্তাদের চাহিদা বাড়ার কারণে মহামারির মধ্যেও বড় ব্যবসাগুলো কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পেরেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এনবিআরের রাজস্ব প্রবৃদ্ধিতে বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন নেই। কোভিডকালে সরকারের রাজস্ব বাড়লেও এটি বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা বাড়ার ফলেই হয়েছে বলে মনে করছেন।
তিনি বলেন, লজিস্টিক সাপোর্ট ভালো থাকায় বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার মধ্যেও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা দিয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ছোট হওয়ার কারণে রাজস্ব কম দেয়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। ফলে রাজস্ব আহরণ তথ্য হেলদি দেখাচ্ছে। তবে ব্যবসার সামগ্রিক চিত্র ভালো নয়।
এদিকে ২০২১ অর্থবছরে দেশে পণ্য বিক্রির বিপরীতে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে সিগারেট শিল্প। পণ্য ও সেবাখাতে সংগৃহীত মোট রাজস্বের প্রায় ২৭ শতাংশ এসেছে এ খাত থেকে। করোনার মধ্যেও পণ্য বিক্রিতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো।
এনবিআর জানিয়েছে, ২০২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১ অর্থবছরে সিগারেট খাতের ব্যবসা বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। সিগারেটের মতোই বিড়িসহ অন্যান্য তামাকপণ্যেও ১০ শতাংশের বেশি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি পেয়েছে এনবিআর।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর চেয়ারম্যান গোলাম মইনুদ্দিন বলেন, করোনার প্রথমদিকে পণ্য সরবরাহে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও তা বেশি দিন ছিল না। শতভাগ কম্প্লায়েন্স মেনে ব্যবসা করায় ট্যাক্স প্রদানও বেড়েছে।
স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কোভিডকালে মানুষের ভার্চুয়াল যোগাযোগ বেড়েছে। ফলে এই সময়ে বেড়েছে ফোন ও ইন্টারনেট ডাটার ব্যবহার। এর প্রভাব দেখা গেছে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের চিত্রেও।
গত অর্থবছরে দেশের চারটি ফোন কোম্পানির রিচার্জের বিপরীতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ রাজস্ব আদায় বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। ২০২০ অর্থবছরে ফোন কোম্পানিগুলোর ট্যাক্স বাবদ রাজস্ব শেয়ারিং ছিল ৬ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৭০ কোটি টাকায়। মোবাইল রিচার্জের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ শতকরা ২৫ শতাংশ পায় সরকার।
যদিও সেলফোন অপরেটররা বলছে, মোবাইল ব্যবহারে করহার বাড়ানোর কারণে এ খাতে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে।
দেশের এক শীর্ষ সেলফোন অপারেটরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালের বাজেটে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এ কারণেই এ খাত থেকে রাজস্ব বেড়েছে।
করোনার কারণে ২০২১ অর্থবছরের বড় একটা সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত ছিল। তারপরও আগের বছরের তুলনায় এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি।
ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ প্রদান, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিড কার্ড, ঋণের হিসাব, আমদানি-রপ্তানিসহ ব্যাংকের সব ধরনের সার্ভিস চার্জ থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায়। এছাড়া ব্যাংকের কেনাকাটায়ও দিতে হয় উৎসে ভ্যাট।
এনবিআর ডাটা বলছে, ২০২১ অর্থবছরে ব্যাংকের এসব চার্জের ওপর ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ভ্যাট পেয়েছে সরকার। আগের বছর এ খাতে আদায়কৃত ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।
করোনাকালে ভালো ব্যবসা করেছে ওষুধ শিল্প। গেল বছর ওষুধ খাতে এনবিআরের ভ্যাট আহরণের প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
যদিও গত অর্থবছরে দেশে ওষুধ খাতে বিক্রি প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিডের কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিকারী সাপ্লিমেন্টের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক হারে। বিশেষ করে ভোক্তা পর্যায়ে ভিটামিন সি ও ডি সাপ্লিমেন্টের চাহিদায় বড় ধরনের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সেক্রেটারি জেনারেল এসএম শফিউজ্জামান বলেন, 'দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও এখন বাড়ছে। ১০ বছর আগেও মানুষ অর্থাভাবে যে রোগের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেত না, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় সে রোগের চিকিৎসার জন্য মানুষ এখন চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। ফলে ওষুধের বিক্রি বাড়ছে।'
গত বছর করোনার লকডাউনের মধ্যেও সচল ছিল আবাসনসহ নির্মাণ খাত। এ খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কনস্ট্রাকশন ফার্মগুলো থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। আর এ খাতের অনুষঙ্গ রড, সিমেন্ট ও সিরামিক থেকেও রাজস্ব ১০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে।
এনবিআরের তথ্যানুসারে, গত বছর স্টিল ও রড শিল্প থেকে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ২৭ শতাংশ, সিমেন্ট খাত থেকে ১১ শতাংশ ও সিরামিকস থেকে ৩৬ দশমিক ১৬ শতাংশ।
চাল, ডাল, মাছ, মাংসসহ বেশ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ভ্যাটমুক্ত। ফলে এসব পণ্যের ব্যবসার তথ্য নেই এনবিআরের কাছে।
তবে গত বছর ভোজ্য তেলের ব্যবহার ১ শতাংশের মতো বেড়েছে। এ সময় কসমেটিকসের ব্যবহার ৩১ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং সাবানের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছোট ব্যবসা
ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ট্রেড ভ্যাট ও টার্নওভার ট্যাক্স নামে রাজস্ব আদায় করে এনবিআর। খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে আদায় করা এ ভ্যাট করোনার পর আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
এনবিআরের তথ্যমতে, ২০১৯ অর্থবছরে ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায়কৃত ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। ২০২০ অর্থবছরে এ ভ্যাট ৩ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা ও ২০২১ অর্থবছরে তা ২ হাজার ১৭০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ এই সময়ে স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা হারিয়েছেন এক-চতুর্থাংশ।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, 'প্রাতিষ্ঠানিক খাতের মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ছোট ট্রেডার্সদের। সবচেয়ে বেশি সময় বন্ধ থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া সব ব্যবসায়ী ঋণী হয়েছেন।'
করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁ, মুদ্রণ, কাগজ, স্টেশনারি, প্যাকেজিংসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা শিল্প খাত। এসব খাত থেকে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।