নালা নাকি মরণ ফাঁদ?
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। প্রকল্পের কাজে নালা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে উম্মুক্ত হয়ে আছে বেশিরভাগ নালা। এসব খোলা নালা-খাল নগরবাসীর মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। উম্মুক্ত এসব নালা ও খালে পড়ে গত চার মাসে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ছয় বছরে মারা গেছেন ছয়জন।
সর্বশেষ গতকাল রাতে মামার সঙ্গে চশমা কিনতে গিয়ে আগ্রাবাদ এলাকায় নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহরিন মাহমুদ সাদিয়ার। এভাবে খোলা নালা ও খালে পড়ে মানুষের মৃত্যু হলেও এসব ঘটনায় দায় স্বীকার করছে না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএ। তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা দাবি করেন, এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর মৃত্যৃ
চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে নালায় পড়ে সেহরিন মাহমুদ সাদিয়া (২০) নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় নালায় পড়ে যান আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ছাত্রী সাদিয়া। ঘটনার চার ঘন্টা পর সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে তার লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
সাদিয়ার বাসা নগরের হালিশহরের বড়পোল এলাকায়। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আলী।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক শামীম আহসান চৌধুরী জানান, নালায় তরুণী পড়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। নালার বিভিন্ন অংশে খোঁজাখুঁজি করেন ডুবুরি দলের সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে নিখোঁজ হওয়ার স্থান থেকে ৩০ গজ দূরে ওই নালা থেকে নিহত ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর তা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আগ্রাবাদের শাহজালাল চশমা মার্কেট থেকে চশমা কিনে মামার সঙ্গে বাসায় ফিরছিলেন সাদিয়া। অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে ও হালকা বৃষ্টিতে রাস্তায় পিছলে নালায় পড়ে যান তিনি। সাদিয়া পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মামা মো. জাকির হোসেনও নালায় ঝাঁপ দেন। কিন্তু, ১২ ফুট গভীর নালার স্রোত ও ময়লা-আবর্জনার কারণে সাদিয়াকে উদ্ধার করতে পারেননি।
জানা যায়, কয়েক বছর ধরে এখানে ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। আগ্রাবাদ মোড় থেকে রবি অফিসের সামনে ও মাইজারগেইট পর্যন্ত কোনো সড়কবাতি নেই। সন্ধ্যার পর এ এলাকা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়।
গত ছয় বছরে ছয়জনের মৃত্যু
গত ২৫ আগস্ট নগরের মুরাদপুর এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় চশমাখালে পা পিছলে পড়ে মুহুর্তের মধ্যে তলিয়ে যান সবজিবিক্রেতা ছালেহ আহমেদ (৫০)। এখনো তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নগরে জলাবদ্ধতার সময় গত ছয় বছরে নালা-নর্দমা ও খালে পড়ে অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন মারা যান গত ৩০ জুন। ওই দিন নগরের মেয়র গলি এলাকায় চশমাখালে পড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগমের (৬৫) মৃত্যু হয়।
এর আগে ২০১৮ সালের ৯ জুন আমিন জুট মিল এলাকায় স্রোতে ভেসে যায় শিশু আল আমীন (৭)। ২০১৭ সালের ২ জুলাই এম এম আলী সড়কে রয়েল গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন বড় নালায় পড়ে তলিয়ে যান সাবেক সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া (৬২)। পরদিন মিয়াখান নগরে চাক্তাই খালে তার লাশ পাওয়া যায়।
বৃষ্টি এবং জলাবদ্ধতার সময় এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটলেও তা এড়াতে কোন ধরণের পদক্ষেপ নেয়নি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় ৯৪৬ কিলোমিটার নালা রয়েছে। তবে কতটুকু নালার উপর বা কয়টি স্ল্যাব রয়েছে, তার তথ্য নেই। আবার ৫৭ খালের মোট দৈর্ঘ্য ১৬১ কিলোমিটার। এসব খালের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী। তবে বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ ২০১৮ সাল থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে চৌমুহনী মোড় থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত নালার উপরে কোন স্ল্যাব নেই। নগরীর ষোলশহর থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত নালাটির কাজ চললেও এখানে বিপদজ্জনক কোন চিহ্ন দেওয়া হয় নি। এভাবে নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় নালাতে নেই কোন স্ল্যাব। খালগুলোতে নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী। যে কারণে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করছে সিডিএ। তাই এই মুহূর্তে সেখানে হাত দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে নগরের নালাগুলোর উপর স্ল্যাব দেওয়ার একটি পরিকল্পনা রয়েছে। এটি হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক কমবে।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলী বলেন, বর্তমানে খাল ও নালাগুলোর পাশে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে যেসব এলাকায় মানুষের বসতি ও যাতায়াত রয়েছে সেখানে দুর্ঘটনা এড়াতে খালের সঙ্গে লাগোয়া রাস্তায় রেলিং দেয়া হবে। নালাগুলোর উপর স্ল্যাব দেওয়া হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, নালা কিংবা খালে পড়ে প্রায় সময় এসব ঘটনা ঘটছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। জলাবদ্ধতা নিরসন কিংবা ফ্লাইওভার, যেকোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সেফটি সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে হবে। যেই কর্মকর্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে এসব ঘটনা ঘটছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা কিংবা বিচারের আওতায় আনা দরকার বলে মনে করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।