চীনের ‘জিম্মি কূটনীতি’ নিয়ে পশ্চিমে বাড়ছে উদ্বেগ
হুয়াওয়ের নির্বাহী মেং ওয়াংঝুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন চীনে 'এক দুর্দান্ত বিজয়' হিসেবে উদযাপিত হয়েছে। বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সমঝোতার ফলাফল হিসেবে চলতি সপ্তাহের শুরুতে মুক্তি পেয়েছেন মেং।
২০১৮ সাল থেকে দীর্ঘ তিন বছর কানাডার ভ্যাঙ্কুরে তার মাল্টিমিলিয়ন ডলারের প্রাসাদে গৃহবন্দী হয়ে ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে হুয়াওয়ের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মেং ওয়াংঝুকে জালিয়াতির অভিযোগে কঠোর নজরদারিতে রেখেছিল কানাডার পুলিশ। তবে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর, মার্কিন ও চীনা কূটনীতিকদের মধ্যে একটি সমাঝোতামূলক আলোচনার মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছেন তিনি।
একটি সরকারি চার্টার্ড প্লেন মেং-কে কানাডা থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসে চীনে। আর তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দেশটিতে হয়ে উঠেছে এক সর্বাত্মক জাতীয়তাবাদী প্রচারণা।
দক্ষিণাঞ্চলীয় শেনজেন শহরে লাল গালিচা বিছিয়ে তাকে সম্মান জানাতে অপেক্ষা করছিল বিশাল জনতার ঢল। তার ফ্লাইটটি বিমানবন্দরে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে, সেখানে দেশাত্মবোধক স্লোগান এবং গান শোনা যায়। তাকে বাড়ি ফেরাকে স্বাগত জানাতে শহরের গগনচুম্বী ভবনগুলোয় করা হয়েছিল আলোকসজ্জার ব্যবস্থা।
তার প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এবং ইন্টারনেটে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। রাষ্ট্রীয় ব্রডকাস্টার সিসিটিভির একটি অনলাইন লাইভস্ট্রিম চলে টানা ছয় ঘণ্টা ধরে, যা ৮৩ মিলিয়নেরও বেশি বার দেখা হয়েছে।
মেং তার ফ্লাইট চলাকালীন একটি দীর্ঘ সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লিখেছিলেন, "শক্তিশালী এই মাতৃভূমি না থাকলে আমি আজ মুক্তি পেতাম না।" তার এই পোস্ট ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারও করা হয়েছে।
দেশের জনগণের সামনে, মেং-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে চীনের কূটনৈতিক বিজয় এবং বিশ্বে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাবের একটি পদচিহ্ন হিসেবেই উপস্থাপন করেছে চীনা সরকার। সেইসঙ্গে, চীনের হাইটেক শিল্পকে বিপাকে ফেলতে মেং-কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের" নিরীহ শিকার বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে মেং-কে নির্দোষ বলে দাবি করা হয়েছে। অথচ একটি ইরানী কোম্পানির সঙ্গে হুয়াওয়ের সম্পর্কের কথা এবং এইচএসবিসি ব্যাংককে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেওয়ার বিষয়টি যে মেং স্বীকার করেছেন, সে ব্যাপারটি চীনা গণমাধ্যম সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছে।
হংকং ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির চীনা রাজনীতি বিশেষজ্ঞ জ্যাঁ-পিয়ের ক্যাবেস্তানের মতে, পুরো কাহিনীটি পক্ষপাতিত্বের ভিত্তিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, তবে এটা আশ্চর্যজনক নয়। কারণ সত্যটি প্রকাশ করলে তা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারতো।
বিশ্লেষকদের মতে, বেইজিংয়ের এই প্রচারণা দেশের জনগণের সামনে কাজ করলেও, বিদেশে ঠিকই সরকারের ভাবমূর্তিকে নষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে, মেং-এর মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই দু'জন কানাডিয়ান নাগরিককে মুক্তি দেওয়ায় বেইজিং বিশ্বের সামনে প্রতিশোধপরায়ণ এক রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত পেয়েছে।
মেং-কে কানাডায় গৃহবন্দি করার পরপরই ২০১৮ সালে ব্যবসায় উদ্যোগতা মাইকেল স্পাভোর এবং সাবেক কানাডিয়ান কূটনীতিক মাইকেল কোভরিগকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে চীন।
বেইজিংয়ের এই কাণ্ড মেং-এর ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবেই সারা বিশ্বে পরিচিতি পায়, যদিও চীন বরাবরই এই দু'জনকে "রাজনৈতিক জিম্মি" হিসেবে অস্বীকার করেছে।
এ মাসের শুরুতেও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একজন মুখপাত্র গণমাধ্যমকে বলেছেন, মেং-এর সঙ্গে কানাডিয়ান নাগরিকদের আটকের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে, জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা আইন বিশেষজ্ঞ ডোনাল্ড সি ক্লার্ক সহ আরো অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, এই দু'টি ঘটনা সম্পর্কযুক্ত। কারণ মেং ও কানাডিয়ান দুই নাগরিকের আটক এবং মুক্তি দেওয়ার সময় খুবই কাছাকাছি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন তার আধিপত্য দেখাতেই মূলত এ কাজ করেছে। এর মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে জানান দেওয়া যে, চীনের উপর ছোট বড় যেকোনো আঘাত আসলে সেও অল্পতে ছেড়ে দেবে না।
দুই কানাডিয়ানকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটিতে চীনের গণমাধ্যম প্রথমে কিছুটা নীরবই ছিল। মেং-এর মুক্তির ঠিক একদিন পর, রোববার রাতে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হয়, কানাডার দু'জন নাগরিক তাদের অপরাধ স্বীকার করার সাপেক্ষে চিকিৎসার জন্য জামিন পেয়েছেন।
এদিকে মেং-এর মুক্তিতে, বেইজিং জাতীয়তাবাদী গৌরবের বিজয়ে আনন্দিত হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই উদযাপন চীনের আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং কানাডার সঙ্গে তার সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটাতে পারে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, এই বছর জরিপে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ কানাডিয়ান চীনের ব্যাপারে নেতিবাচক মতামত দিয়েছেন; যা ২০১৭ সালে ছিল ৪০ শতাংশ।
তবে, মেং এবং দুই মাইকেলের মুক্তি হুয়াওয়ে বা বেইজিংয়ের উপর থেকে ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা সরাতে সাহায্য করবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আর এখন অনেক পশ্চিমা দেশেই, চীনের "জিম্মি কূটনীতি" নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
হংকং ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির ক্যাবেস্তান মনে করেন, বেইজিং আন্তর্জাতিক ইমেজের চেয়ে দেশের ভিতরের জন সমর্থনকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।
তিনি বলেন, "আন্তর্জাতিকভাবে, তারা সফট পাওয়ারের চেয়ে হার্ড পাওয়ারকেই বেশি গুরুত্ব দেয়; চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছে, ভালোবাসার চেয়ে ভয় পাওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"
সূত্র: সিএনএন