মমতার বিজয় ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য মঙ্গলবারতা!
ভারতে ভবানীপুরের উপনির্বাচনে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতবেন, এটা যেন সকলের জানা ছিল। সে কারণে নজর ছিল ব্যবধানের দিকে। সেখানেও রেকর্ড ব্যবধান। চলতি বছরের বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে ১৫ শতাংশ ভোট বেড়েছে তৃণমূলের।
গত বৃহস্পতিবারে অনুষ্ঠিত আরও দুটি উপনির্বাচনেও তৃণমূল জয়লাভ করেছে। এক কথায়, পশ্চিমবাংলায় তৃণমূলের জয়জয়াকার।
তারপরও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতাকে পশ্চিমবঙ্গ সপ্তদশ বিধানসভার সাধারণ নির্বাচনে নিজ আসনে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ নিতে হয়েছিল। শুভেন্দু অধিকারীর দল ত্যাগ করে বিজেপিতে (ভারতীয় জনতা পার্টি) যোগ দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহজভাবে নিতে পারেননি। তিনি পূর্ব মেদেনিপুরের নন্দীগ্রাম আসনে শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধেই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে শুভেন্দু অধিকারীকে দল ত্যাগের 'উচিত' শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন।
৩ মে ঘোষিত ফলাফলে তেমনটি ঘটেনি। কিছুটা হলেও হোঁচট খেতে হয়েছিল। মানুষ বোধহয় দম্ভ পছন্দ করে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে যেখানটিতে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন, সেই নন্দীগ্রামের ইতিহাস সরাসরি যুক্ত। শিল্প ও বাণিজ্যে পিছিয়ে থাকা রাজ্যে শিল্পায়নের লক্ষ্যে অধিগ্রহণকৃত জমি ফিরিয়ে দেবার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একইসঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান এবং তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান ঘটে। মমতার নেতৃত্বে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গঠন করে। টানা তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া মমতা খুব অল্প বয়সে ১৯৭০ সালে কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭৬ সালেই রাজ্য মহিলা কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বর্ষীয়ান বাম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে অন্যতম বয়োকনিষ্ঠ সাংসদ হয়েছিলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ লড়াকু রাজনৈতিক জীবন। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত পশ্চিমবাংলার 'দিদি'র রাজনৈতিক কৌশল এখন নানাদিকে আলোচিত হচ্ছে। ধর্ম নিরপেক্ষতার ঐতিহ্য থেকে ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ব ধর্মতত্ত্বের বিকাশ- যা সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উগ্রবাদের জন্ম দিবে, তার বিপরীত রাজনীতির সন্ধানে সকলে।
পশ্চিমবাংলা স্বপ্ন দেখছে দিদিকে নিয়ে। পশ্চিমবাংলার দৈনিকগুলো নানা শিরোনাম করেছে। এই উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট ৩৫ শতাংশ থেকে নেমে ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ৫৭ থেকে ৭২ শতাংশে উন্নীত তৃণমূল। ভবানীপুরের হাজারও ব্যানারে দিদিকে 'মোদিশাহসুরমর্দিনী' বলা হয়েছে। দেবি দুর্গা যেভাবে মহিষাসুরকে বধ করে 'মহিষাসুরমর্দিনী' হয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি দিদি এবারের নির্বাচনে মোদি-শাহকে পরাজিত করে দেশে ধর্মীয় রাজনীতির ব্যাপকতার অবসান ঘটাবেন।
মোদি বিরোধী সর্বভারতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব কংগ্রেসে হাতে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কংগ্রেসের ঐতিহ্য, সর্বভারতীয় দলীয় কাঠামো, সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি বিবেচনায় সবাই কংগ্রেসকে এগিয়ে রাখে। এ রকম কোনো জোট আগামী নির্বাচনে নেতৃত্ব দিবে এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভারত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। প্রাথমিক প্রচেষ্টা এগিয়েছে অনেকটা।
জোট নেতৃত্বের ভাগিদার এখন তৃণমূল নিজেও। পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজ মমতাকে ভারতের আগামীদিনের প্রধানমন্ত্রী চিন্তা করছে। এমনটি হতে হলে তৃণমূলের রাজনীতি এবং আগামীদিনের অঙ্গীকার ভালোভাবে বুঝতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্মীয় তোষণের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। সংখ্যার দিক বিবেচনায় ছোট অথবা বড় ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গঠন সম্ভব কি না, সেটা আজ বড় প্রশ্ন। এবং সেটা যদি হয় ক্ষমতা আরোহনের সিঁড়ি, তাহলে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিগুলোকে সমাজ ও ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। একক শক্তিতে পরিণত হবার বাসনায় সমাজে বিদ্যমান সকল রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ নির্মূলে 'বড় দলের আগ্রাসী মনোভাব' ও রাষ্ট্রীয় শক্তি বিরাট ভূমিকা রেখেছে। গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির শূন্যতায় ধর্মীয় মৌলবাদী শেকড় গেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তৃণমূল ও তার নেত্রী এই দায় এড়াতে পারবেন?
তৃণমূল গঠনের প্রথম পর্যায়ে হাত ধরতে হয়েছিল উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী আরএসএস- বিজেপি'র। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস বিরোধিতার জন্য মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা দখল করা এবং আর এসএস- বিজেপিকে বিরোধী আসনে নিয়ে আসা। একটা মিলমিশ আপস-রফা। আজকে পশ্চিমবাংলায় সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৯৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। ১৯৯৯ সালে মমতা অটল বিহারী বাজপেয়ির বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে সামিল হন। এই জোট সরকার গঠন করলে তিনি যুবকল্যাণ মন্ত্রী মনোনীত হন। পরে মনমোহন সরকারে ভিড়ে রেলমন্ত্রী হন। ২০০১ সালে এনডিএ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আবার ২০০৪ সালে এনডিএতে ফিরে আসেন এবং কেন্দ্রীয় কয়লা ও খনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। অর্থাৎ, তৃণমূল শুরুতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে থেকে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করতে হয়েছে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে সরকারের দুর্নীতি, সংখ্যালঘু ও রাজ্যে বেকারত্ব খুব জোরেশোরে সামনে এলেও ক্ষমতাসীনরা তাদের সময়ে নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোই বেশি করে সামনে নিয়ে আসে। নারী, শিশু, স্বল্প আয় ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো সফলতা পেলেও স্বজন তোষণ, দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ উঠে। উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে কিছু 'পাইয়ে' দেবার বিনিময়ে ভোট প্রত্যাশা প্রধান। এইসব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের উপাদান কম।
২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রায় ১০০টি আসনের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিতে পারে ৩০% মুসলিম ভোট। কাজেই ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস এই ভোট নিজের দিকে ধরে রাখতে সচেষ্ট। ইসলামিক কায়দায় মাথায় কাপড় দিয়ে মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তৃণমূল নেতা নেত্রীকে হাজির হতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, মসজিদ ও মাদ্রাসায় উন্নয়ন ও সরকারি অনুদান পাইয়ে দেবার একটা হিড়িক লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবণতার সঙ্গে আমাদের দেশের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
তৃণমূলের মাইনরিটি সেল খুবই সমাদৃত। সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার এই কৌশল একটি ভ্রান্ত কৌশল। এইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সংখ্যালঘুদের বাড়তি সুরক্ষা দেবার নামে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া।
বাংলাদেশ ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পাশের দেশ। দুই দেশের বন্ধুত্ব, পারস্পারিক সহযোগিতা এই অঞ্চলের শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এ দেশের মানুষের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সংশ্লিষ্টতা অনেক বেশি। আমাদের সরকার প্রধানরা সব সময় চেষ্টা করেন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে এবং একটু বাড়তি কিছু করতে। ইলিশ কূটনীতি দৃশ্যমান; কিন্তু তিস্তার পানি বা সীমান্ত হত্যা বন্ধের কার্যকর তৎপরতা দৃশ্যমান নয়।
হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ও তার সমমনাদের বিরুদ্ধে আরও বড় লড়াই সামনে অপেক্ষা করছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন, দারিদ্র, বেকারত্ব, শিল্পবিকাশে স্থবিরতা, করোনা মোকাবেলায় অদক্ষতা, কৃষক আন্দোলন, কাশ্মীর সমস্যা এবং আন্তর্জাতিকভাবে চীন ও হালে আফগান প্রশ্নে বেকায়দায় থাকা ক্ষমতাসীনদের ধর্মীয় বড়ি খুব একটা কাজে আসবে মনে হয় না। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিরোধী জোট তৎপরতা গুরুত্বপূর্ণ।
কংগ্রেসের নিজস্ব নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে; কিন্তু দল হিসেবে তার সর্বভারতীয় অবস্থান অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস বা তার নেতা-নেত্রী সে ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে আছে- এটা মাথায় থাকলে সবকিছু অনেকটা সহজ হবে।
তবে এই নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভে আমরাও দিদিকে অভিনন্দন জানাই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদের বিকাশ আমাদেরকেও বেকায়দায় ফেলে। তৃতীয় মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বপালনকালে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিকাশ ঘটবে, সেটাই কামনা করি।
-
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক