পরবর্তী মহামারি ঠেকাতে সব ধরনের করোনাভাইরাসের জন্য একটি ভ্যাকসিন খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা
করোনাভাইরাস গোত্রের একটি নতুন ভাইরাস সার্স কোভ-২, বিশ্বব্যাপী যা মহামারির জন্ম দিয়েছে। ডেল্টাসহ মারাত্মক সব ধরনের উৎস এ ভাইরাসটিরই অভিযোজন প্রক্রিয়া। করোনাভাইরাস গোত্রের অন্যান্য ভাইরাসও অতীতে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রামক রোগ ছড়ায় এবং নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতেও ছড়াবে। এর কোনটি হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ মহামারির জন্ম দেবে, এমন ঝুঁকিও প্রবল।
তাই বর্তমান ও আগামী দিনের মহামারি দুটির বিরুদ্ধেই যুদ্ধজয়ে নেমেছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, উদীয়মান সংক্রামক রোগ গবেষক ও মার্কিন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ডা. কেভন মোডজ্জার্যাড।
কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী মারাত্মক নতুন কোনো ধরন যা টিকা প্রদত্ত সুরক্ষাকে ফাঁকি দিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারবে, ভবিষ্যতের এমন ধরন আবির্ভাবের ঝুঁকি রয়েছে। করোনাভাইরাস গোত্রের অন্য ভাইরাসের হুমকি তো আছেই, কিন্তু এসব বিপদ মোকাবিলায় সার্বজনীন একটি টিকা তৈরির চেষ্টা করছেন ডা. কেভনের নেতৃত্বাধীন গবেষক দল।
তাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য, পরবর্তী মহামারি পৃথিবীজুড়ে বিস্তার লাভের আগেই তা প্রতিহত করা। এমনকি এ টিকা সাধারণ সর্দি-কাশি বা ফ্লু'র জন্য দায়ী করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকেও মানুষকে রক্ষা করবে।
এমন অতি-সম্ভাবনাময় টিকার সন্ধানে পৃথিবীজুড়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের ২০টি দল, কেভনের টিমও আছে এ তালিকায়।
তারা যে টিকা আবিষ্কার করতে চান সেটিকে সার্বজনীন বলার পাশাপাশি বলা যায় প্যান-করোনাভাইরাস, বা সকল ধরনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের ফলদায়ক টিকা। একটি টিকাই পারস্পরিক সম্পর্কিত সব ভাইরাসকে ঠেকাবে। এমনকি এখনও যে করোনাভাইরাসের উদ্ভব ঘটেনি, সেটির বিরুদ্ধেও কার্যকর হবে।
দীর্ঘদিন ধরে ইবোলা, জিকা ও এইচওয়ানএনওয়ান ফ্লু মহামারি ও অন্যান্ত প্রাণঘাতী জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইকারী কেভন মোডজ্জার্যাডসহ অন্য উদীয়মান রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীতে আবির্ভূত হতে চলা শক্তিশালী ভাইরাসের আঘাত হানার শক্তি খর্ব করতেই তারা এমন ভ্যাকসিনের সন্ধান করছেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের অবস্থিত ওয়াল্টার রিড আর্মি ইনস্টিটিউট অব রিসার্চের উদীয়মান সংক্রামক রোগ শাখার পরিচালকের পদে কর্মরত আছেন মোডজ্জার্যাড । যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর শীর্ষ এ চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র, বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির গবেষণাগারে সমৃদ্ধ ও সেরা মেধাবী বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
তিনি বলেন, "আমরা শুধু এ মহামারি থেকে মানবজাতির মুক্তির উপায় খুঁজছি এমন নয়, বরং বলা যায়, আগামীর সকল প্রাদুর্ভাবের চক্র ভাঙতে চাচ্ছি।"
গত ১৮ বছরে মিডল ইস্ট র্যাস্পেটরি সিনড্রোম (মার্স) রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের মতো করোনাভাইরাস গোত্রের তিনটি মারাত্মক ভাইরাসের উদ্ভব ঘটেছে। নতুন আরেকটি ভাইরাসের আবির্ভাবও ঘটবে নিশ্চিতভাবেই। কারণ, বাদুর ও খরগোসের মতো অনেক প্রাণীদেহ থেকে করোনাভাইরাস মানবদেহে ছড়াতে পারে।
তবে চলমান মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ সার্স কোভ-২ ভাইরাসের সংস্পর্শে আসছেন, যা টিকার প্রভাব সহনশীল ধরন আবির্ভাবের হুমকি সৃষ্টি করেছে, বলে ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা।
এনিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের মেডিসিন বায়োকেমিস্ট ড. ডেভিড ভিজলার বলেন, "আমাদের এসব নতুন ধরনের ভাইরাস-সহ আরও অনেকগুলো নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।"
বর্তমানে ড. ভিজলারের বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগারেই বেশকিছু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি পরীক্ষামূলক টিকার টেস্টিং চলছে।
দীর্ঘদিন ধরেই ইনফ্লুয়েঞ্জার সার্বজনীন টিকা তৈরির চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা, কিন্তু সফলতা এখনও অধরা। করোনাভাইরাস গোত্রের অভিযোজন তুলনামূলক কম হওয়ায়, এগুলোর বংশক্রম সহজে শনাক্ত করা যায়, যেকারণে টিকা তৈরির গবেষণায় এগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করাও তুলনামূলক সহজ।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম বেশিরভাগ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি সার্বজনীন টিকা তৈরিতে অনেক বছর সময় লাগবে, আর জয় করতে হবে বহু জানা-অজানা চ্যালেঞ্জ।
আশার কথা হলো, বিজ্ঞানীদের চেষ্টা জোরতালেই চলছে। কোভিড-১৯ মহামারির ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক ক্ষতি উপলদ্ধি করেই উন্নত দেশগুলোর সরকার বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জোর সমর্থনও দিচ্ছে।
তহবিল সহযোগিতা মিলছে আন্তর্জাতিক দাতাদের পক্ষ থেকেও। বিপজ্জনক কিছু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি টিকার প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণায় ২০ কোটি ডলার অর্থায়ন দিচ্ছে নরওয়ের অসলো ভিত্তিক একটি জোট- কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস এর বিজ্ঞানীরা সব ধরনের করোনাভাইরাস টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। গবেষণায় বাড়তি সাহায্যের জন্য সরকারি সংস্থাটি অন্য গবেষকদের সাড়ে ৯ কোটি ডলারের অনুদান দিচ্ছে। এরমধ্যে তিন কোটি ৬০ লাখ ডলারের অনুদান পাচ্ছেন পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি হাসপাতালের গবেষক দল।
যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু বেসরকারি কোম্পানিও মাল্টিভ্যালেন্ট কোভিড-১৯ টিকা তৈরির গবেষণা করছে, যা সার্স কোভ-২ ভাইরাসের সকল ধরনের বিরুদ্ধেই অত্যন্ত কার্যকর হবে।
এব্যাপারে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউট এর পরিচালক এরিক টোপোল বলেন, "বাইডেন প্রশাসনসহ অন্যান্য দাতাদের উচিত নতুন ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকার গবেষণায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থায়ন করা। এজন্য বৈশ্বিক পর্যায়ে এক সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।"
এ পর্যন্ত গবেষণাধীন টিকাগুলো সকল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় না। কারণ প্রতিটি ভাইরাস একে অপর থেকে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, ফলে একটি টিকার মাধ্যমে সবগুলোকে টার্গেগ করাটা বৈজ্ঞানিকভাবে বেশ জটিল।
মানুষের দেহে ছড়ানোর পূর্বে, বাদুর বা অন্য পোষক বন্যপ্রাণীর দেহে যে করোনাভাইরাস থাকে, সেগুলোকে সার্বেকোভাইরাস বলা হয়। কোভিড-১৯ সহ সিভিয়ার একিউট র্যাস্পেটরি সিনড্রোম (সার্স)- এর জন্য দায়ী এসব ভাইরাসের পরিবর্তিত ধরন। এজন্য প্রথমে সার্বেকোভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।
একবার তারা সার্বেকোভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরি করতে সফল হলে, পরবর্তী ধাপে মানবদেহে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য উপযোগী বেটাকরোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা তৈরির চেষ্টা করবেন। মার্স রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসও ছিল এ ধরনের বেটাকরোনাভাইরাস, ২০১২ সালে প্রথম শনাক্ত এ রোগে মৃত্যুর হার ৩৫ শতাংশ।
বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে ডা. মোডজ্জার্যাড বলেন, "এক লাফে মঙ্গলে যাওয়া যায় না, এজন্য আগে চাঁদে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হয়।"
- সূত্র: দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল