শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও ইরান-আজারবাইজানে কেন এত রেষারেষি?
যুদ্ধকালীন সময়ে যাতে সামরিক বাহিনীর কার্যক্ষমতা অটুট থাকে সেজন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সামরিক মহড়ার আয়োজন করে থাকে একক অথবা যৌথভাবে। ইসলামিক রিপাবলিক ইরানেও নিশ্চয়ই এই প্রথার ব্যত্যয় ঘটেনা, তারই ধারাবাহিকতায় তারা ১ অক্টোবর থেকে তাদের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আজারবাইজান সীমান্তের কাছাকাছি শুরু করে নতুন এক সামরিক মহড়ার, যেখানে তাদের নিজেদের তৈরি দূরপাল্লার ড্রোনও প্রথমবারের মত পরখ করা হবে। আপাতদৃষ্টিতে এটি স্রেফ ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয় তথা সার্বভৌম অধিকার মনে হলেও, এটা যে ককেশাস অঞ্চলে উত্তেজনার বারুদ ছড়িয়ে দিয়েছে তা বাকুর প্রতিক্রিয়ায় প্রতীয়মান হয়। আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ তেহরানের এমন মহড়ায় আশ্চর্য প্রকাশ করেছেন যা কিনা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সবচে বড় সামরিক মহড়া বলে বিবেচিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিটি ঘটনারই একাধিক তাৎপর্য থাকে, দেশগুলো একে অপরের সার্বভৌমত্বের উপর যেমন শ্রদ্ধাশীল তেমন নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরো বেশি সচেতন, রাষ্ট্রগুলো তাই সবসময় "ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো" নীতিতে এগিয়ে চলে, ইরান-আজারবাইজান সম্পর্কের সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ অন্তত এটাই প্রমাণ করে। উভয়েই একে অপরের সংবেদনশীল জায়গায় আঘাত করে অন্যের কর্তৃত্ব দমিয়ে রাখতে চায়। ইরান নাগর্নো-কারাবাখ ইস্যুতে গোপনে আর্মেনিয়াকে সমর্থন দিয়ে আর আজারবাইজান বিপরীতে বিপ্লবোত্তর ইরানের প্রধান শত্রু ইসরায়েলের সাথে সখ্যতা গড়ে বিরোধ বজায় রেখেছে। রাষ্ট্র কেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থায় একে অপরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠলেও রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিকসহ ধর্মীয় কারণে বন্ধুত্বের নজিরও কম নয়।
বর্তমান আস্থাহীন সম্পর্ক বাদ দিলে, এই দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট মিল আছে। প্রথমে, দুটি দেশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিয়া ইসলামে বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিকভাবে উভয়েই প্রায় একই ঐতিহ্যের ধারণ করে, এমনকি ১৯ শতকের গোড়ার দিকে তথা রুশ-পারস্য যুদ্ধের আগ পর্যন্ত আজারবাইজান ইরানেরই অংশ ছিলো পরে যা রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
ইরানের পূর্ব ও পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশেও উল্লেখযোগ্য আজারি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে, পার্সিয়ানদের পর এরা ইরানের ২য় বৃহৎ জাতি (১৫ মিলিয়নের কাছাকাছি) সংখ্যায় যা আজারবাইজানের আজারিদের চেয়েও বেশি। প্রশ্ন হল এরা কেন ইরান আজারবাইজান সম্পর্কের মাঝে কাঁটা হয়ে উঠল? প্রথমত এরা ইরানের সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে সেখানকার পার্সিয়ানদের কাছে বৈষম্যের শিকার হয়েছে যার, সুযোগে তাদের মধ্যে তুর্কি-আজারি জাতীয়তাবাদ আরো প্রবল হয়েছে। এছাড়া আজারবাইজানের তুর্কিপন্থি নেতৃত্ব যে বৃহত্তর আজারবাইজানের স্বপ্ন দেখে তাতে ইরানের আজারবাইজান প্রদেশও অন্তর্ভুক্ত। আজারিদের এই আকাঙ্ক্ষাই ইরান তার রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
সম্পর্কের এমন গভীরতা থাকা সত্ত্বেও, ইরান নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাতে আজারবাইজানকে সমর্থন দেয়নি কখনো। ইরান যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের জড়িয়ে ইসলামি বিশ্বের ত্রানকর্তা ভাবতে আগ্রহী সেখানে আর্মেনিয়ার মুসলিমদের বিরুদ্ধে পবিত্র ভূমি রক্ষার সংগ্রামে আজারবাইজানের পাশে না থাকাটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বটে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সাথে ইরানের মতপার্থক্য মূলত শিয়া বিভাজনকে কেন্দ্র করেই তাহলে প্রশ্ন উঠে আজারবাইজান শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া স্বত্তেও কেন ইরানের সাথে এত রেষারেষি, কেন ইরান বিরোধপূর্ণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল লাগোয়া তাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মেতেছে?
ইরানের আজারি জাতিগোষ্ঠী
বর্তমান আজারবাইজানের শতকরা ৯৫ ভাগ লোক জাতিগতভাবে আজারি, এরা মূলত ককেশীয় ও ইরানি। পরে তুর্কি সংমিশ্রণে এখনকার অবস্থায় এসেছে, এরা আবার ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সাফাভি, উসমানীয় ও রুশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। ইরানের পূর্ব ও পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশেও উল্লেখযোগ্য আজারি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে, পার্সিয়ানদের পর এরা ইরানের ২য় বৃহৎ জাতি (১৫ মিলিয়নের কাছাকাছি) সংখ্যায় যা আজারবাইজানের আজারিদের চেয়েও বেশি। প্রশ্ন হল এরা কেন ইরান আজারবাইজান সম্পর্কের মাঝে কাঁটা হয়ে উঠল? প্রথমত এরা ইরানের সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে সেখানকার পার্সিয়ানদের কাছে বৈষম্যের শিকার হয়েছে যার, সুযোগে তাদের মধ্যে তুর্কি-আজারি জাতীয়তাবাদ আরো প্রবল হয়েছে। এছাড়া আজারবাইজানের তুর্কিপন্থি নেতৃত্ব যে বৃহত্তর আজারবাইজানের স্বপ্ন দেখে তাতে ইরানের আজারবাইজান প্রদেশও অন্তর্ভুক্ত। আজারিদের এই আকাঙ্ক্ষাই ইরান তার রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
ফলে তারা শিয়া হওয়ার পরেও ভূরাজনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে আজারিদের মোকাবিলায় কৌটিল্যের তত্ত্বের মত শত্রুর শত্রুকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছে। নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে যুদ্ধে আর্মেনিয়াকে সহায়তা বা হালের সামরিক মহড়ার মাধ্যমে তারা এটাই বুঝাতে চাচ্ছে পাশাপাশি এতে আরেক মিত্র রাশিয়াকেও খুশি রাখতে পারছে তারা।
আজারবাইজানের ইসরায়েলপ্রীতি
ইরান যেমন আজারবাইজানকে চাপে রাখতে আর্মেনিয়া কার্ড খেলছে, আজারবাইজান ও তেমনি মনোযোগী ছাত্রের মত কৌটিল্যের নীতি অনুসরণ করে চলছে। ১৯৭৯ পরবর্তী আলি খোমেনির ইরানের প্রধান ও প্রথম শত্রু বলে বিবেচিত হয় ইসরায়েল, মধ্যপ্রাচ্যের সকল ইস্যুতে দেশ দুটির অবস্থান শতভাগ বিপরীতে, বলা হয়ে থাকে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের হত্যার পিছনে ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব আছে, এমনকি দেশ দুটির 'নিরাপত্তা কাঠামোর' প্রায় পুরোটা জুড়েই লক্ষ্য একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করা।
এত দিন ইরান দখলকৃত আজারবাইজান অঞ্চল দিয়ে সহজেই আর্মেনিয়াতে প্রবেশ করতে পারত। গত বছর এসব ভূখণ্ডের পুনর্দখল নেওয়ার পর থেকে আজারবাইজান ধীরে ধীরে ইরানি যানবাহনের উপর কর ধার্য করতে শুরু করে। গত মাসে এমনকি 'অবৈধ'ভাবে আজারবাইজানের ভূখন্ডে প্রবেশের দায়ে ২ ইরানি ট্রাক ড্রাইভারকে বন্দি করে বাকু, যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলা হয়েছে ইতিমধ্যে।
এমন হিসাব নিকাশে আজারবাইজান ইরানকে চাপে রাখতে ইসরায়েলকে ঘরের কাছে জায়গা করে দিয়েছে বলা চলে। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআইপিআরআই) তথ্যমতে ইসরায়েল ২০০৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আজারবাইজানকে ৮২৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। বলা বাহুল্য ইসরায়েলের উন্নত প্রযুক্তির ড্রোন তথা সমরাস্ত্রের জোরেই গতবছরের সংঘাতে সফল হয়েছিল বাকু, ইরানের সীমানার কাছেই ইসরায়েলের এমন সামরিক উপস্থিতি তাদের জন্য যথেষ্ট চিন্তার কারন। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানের বক্তব্যেও তারা যে ইসরায়েল প্রশ্নে কোন ছাড় দিবে না তার রেষ পাওয়া গিয়েছে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনা
এমনিতেই ইরানের সাথে আজারবাইজানের সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, তার উপর 'আগুনে ঘি ঢালার' মত ঘটনা ঘটছে গত এক মাস যাবৎ যার সূচনা বাকুতে আজারবাইজান, তুরষ্ক ও পাকিস্তানের যৌথ সামরিক মহড়া। তুরষ্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্নে কৌশলগত মিত্রতা থাকলেও আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের পথে দ্বন্দ্ব আছে ইরানের, সেই বিবেচনায় বাকুতে এমন আয়োজন যে ইরানের বিরুদ্ধে আঙ্কারার জোটবদ্ধতা তা মোটামুটি পরিষ্কার।
ঘটনা এতেই শেষ নয়, এত দিন ইরান দখলকৃত আজারবাইজান অঞ্চল দিয়ে সহজেই আর্মেনিয়াতে প্রবেশ করতে পারত। গত বছর এসব ভূখণ্ডের পুনর্দখল নেওয়ার পর থেকে আজারবাইজান ধীরে ধীরে ইরানি যানবাহনের উপর কর ধার্য করতে শুরু করে। গত মাসে এমনকি 'অবৈধ'ভাবে আজারবাইজানের ভূখন্ডে প্রবেশের দায়ে ২ ইরানি ট্রাক ড্রাইভারকে বন্দি করে বাকু, যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলা হয়েছে ইতিমধ্যে।
সবশেষ, ইরান আশঙ্কা করছে গতবছর কারাবাখে যুদ্ধে অংশ নেওয়া আইএস যোদ্ধারা এখনো সেখানে অবস্থান করছে, এই ঘটনার সত্যতা ইরানের জন্য আসলেই মাথা ব্যাথার কারন হয়ে উঠতে পারে যেহেতু আইএস শিয়া প্রসঙ্গে কট্টরপন্থী আবার সিরিয়াতে উভয়েই মুখোমুখি অবস্থানে ছিলো। এখানে সব কিছু আসলে নির্ভর করবে তুরস্কের মনোভাবের উপর, যেহেতু সিরিয়াতে সুন্নি ফ্রন্টগুলোর সাথে তাদের বোঝাপড়া ছিলো পাশাপাশি এই মুহুর্তে বাকুর সবচে প্রভাবশালী সহযোগী তারাই।
ইরান ভূরাজনীতিকে সবসময় ধর্ম দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেও আজারবাইজানের সাথে দ্বন্দ তাদের উভয় সংকটে ফেলেছে, রাষ্ট্রের কাছে দিনশেষে সবকিছুর উর্ধে জাতীয় স্বার্থই যে মুখ্য তা আবার প্রকট হল এখানে। ইরানও কোন পথ বেছে নিলো তা তাদের সামরিক মহড়াই বলে দিচ্ছে তবে এটা আর যাইহোক বড় ধরনের কোন ঝামেলায় রূপ নিবে না তা একপ্রকার নিশ্চিতই কারন ইরান নতুন করে অন্যান্য সীমান্তের মত এখানে ঝুঁকি নিতে চাইবে না।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।