নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুবিধা কে পাবে? ভারত না চীন?
২য় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) মিত্রশক্তির কাছে জার্মান তথা অক্ষশক্তির পরাজয়ের মাধ্যমে নতুন যে বিশ্বব্যবস্থার সূর্য উন্মোচিত হয়েছিল তার জোয়ারে ধাক্কা লেগেছিল সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের গায়েও, এমনকি বিজয়ী ব্রিটিশদেরও সেই স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে উপনিবেশ ধরে রাখা সম্ভবপর ছিল না। এর ফলশ্রুতিতে ক্ষমতার পালাবদলে দীর্ঘসময় অবধি সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নিপীড়িত তৃতীয় বিশ্ব পেলো অতীত শৃংখল থেকে বেরিয়ে আত্মপরিচয়ে বাঁচার অধিকার।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন করে জন্মলাভ করা এই জাতি-রাষ্ট্র সমূহ পরবর্তী সব ধাপে আর ব্যবস্থায় নিজেদের কতটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাখতে পেরেছে আর কতটাই নিজেরা থাকতে চেয়েছে? নাকি নানান সময়ে নানান মোড়লদের হস্তক্ষেপে সাম্রাজ্যবাদ এখনও চোখ রাঙাচ্ছ এই তটে?
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর নিজেদের মত করে বাঁচার যে আশায় বুক বেধেছিল এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাতিন আমেরিকার অনেক দেশ সেটার জলাঞ্জলি ছিল দ্বিমেরু বিশিষ্ট বিশ্ব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতার সংঘাত। নিজেরা সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে বরং পুরো বিশ্বকে দুই আদর্শের ব্লকে আলাদা রেখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল স্নায়ু যুদ্ধের ময়দানে। যার আচ থেকে রক্ষা পায় নি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিও, পাকিস্তান অনেক আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটো-সেন্টোতে যোগ দিলেও ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকায় কিছুটা দোদুল্যমান ছিল বটে তবে পরের রাজনৈতিক ঘটনাচক্রে বিশেষত ১৯৬২ সালে চীনের সাথে পরাজয়ের ফলে শেষতক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনের পাকিস্তান ঘেঁষা নীতির বিপরীতে ক্ষমতা কাঠামোয় ভারসাম্য আনায়নে সোভিয়েতের সাথে ২০ বছরের মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগ পর্যন্ত এমন দ্বন্দ্ব-সংঘাত অব্যাহত থাকলেও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারেরা মনে করেছেন একবিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে পরিস্থিতিও বদলাবে হয়ত।
কিন্তু যেমনি "রাজা আসে রাজা যায়, শাসন জারি থাকে" তেমনি সাম্রাজ্যবাদেরও পুনর্জন্ম ঘটে বারবার। দক্ষিণ এশিয়ায় ঠিক এই সময়ের ঘটনা পরিক্রমায়, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর তুলনামূলক ছোট প্রতিবেশীদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্রমশ হস্তক্ষেপ, সেখানকার কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণের লড়াই এবং সেই যাত্রায় রাজনৈতিক দলগুলোর শামিলে যে সমীকরণ দাঁড়ায় তা নয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যাবর্তন আসন্ন করছে কিনা সে প্রশ্ন উঠে আসছে।
সেই উত্তর পাওয়া যেতে পারে ঠিক এই মুহূর্তে চলমান নেপালের রাজনৈতিক সংকটের দিকে দৃষ্টিপাত করলে। ২০১৮ সালে সেখানে চীনা প্রভাবে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ও প্রচন্ডের নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) এক হয়ে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপ নেয়। যারা পার্লামেন্টের ২৭৫ আসনের ১৭৪ (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ১২১, মাওবাদী ৫৩) নিশ্চিত করে ক্ষমতায় এসেছিল। আর স্থির হয়েছিল কে.পি. শর্মা ওলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারি কাজ দেখবেন অন্যদিকে দলীয় প্রধান হিসেবে পুষ্পকমল দহল প্রচন্ড পার্টির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করবেন। তবে এটা যে ঠিকমতো কাজ করে নি তার প্রমাণ কয়েকমাস ধরে চলা দ্বন্দের কারণে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আসতে পারে এমন আশংকায় হুট করে প্রধানমন্ত্রী ওলির সুপারিশে রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভান্ডারী ২০ ডিসেম্বর নিম্নকক্ষ ভেঙে দেন। এর প্রতিবাদে প্রচন্ডের সাথে একজোট হয়ে দুই বিরোধী দল নেপালী কংগ্রেস ও জনতা সমাজবাদী দল আন্দোলনে নামলেও তারা চায় আগাম যে নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে তাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা, কিন্তু এপ্রিল নাগাদ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম এবং এই সময়ে সংকট আরো বাড়বেই বটে। তাই পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেই লক্ষে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপমন্ত্রী গুয়ো ইয়েঝুর নেতৃত্বে দুই পক্ষের সাথেই আলোচনা চালিয়েছে চীন এবং তাতে শেষপর্যন্ত ভাঙ্গন ঠেকাতে না পারলে বর্তমান বিরোধীদের নিয়ে 'প্লান বি'ও কাজে লাগানোর কথা ভাবছে চীন। এদিকে জানুয়ারীতে ভারতে সফররত একটি প্রতিনিধি দলের সাথে সেখানে যাওয়ার কথা আছে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গেওয়ালীর যেখানে বর্তমান সংকট নিয়ে আলোচনাই যে প্রাধান্য পাবে তা বলাই বাহুল্য।
আপাতদৃষ্টিতে নেপালের এই সংকটের জন্য তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দায়ী হলেও এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে পরাশক্তিদের নিজেদের স্বার্থের লড়াই। কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে নেপালে বাড়তে থাকে চীনা প্রভাব যেই ইন্ধনে নেপাল মানচিত্র ইস্যু নিয়ে সরাসরি ভারত বিরোধী অবস্থান নেয়, হয়ত এখনকার রাজনৈতিক সংকট তার একপ্রকার খেসারত। সামনের দিনে ক্ষমতা কাঠামোয় নেতৃত্বের আসনে থাকার যে বাসনা রয়েছে চীন-ভারতের তাতে মুখ্য কার আঞ্চলিক আধিপত্য কতটা। সেই প্রশ্নের উত্তর ঘটা করে জানিয়ে দিতেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে তাদের এত আয়োজন, যার বলি সেইসব রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। এই আয়োজনে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোই কিয়দাংশে ধাবিত করছে তাদের বৈদেশিক মিত্রদের সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকতে। চীন-ভারতের ক্ষমতাকেন্দ্রিক এই 'পার্টি পলিটিক্স' নেপালেই যে প্রথম এমনটা নয়, এর আগে ২০১৯ এ শ্রীলঙ্কায় চীনকে বন্দর লিজ দেয়া নিয়ে মাইথ্রিপালা সিরিসেনা আর রনিল বিক্রমাসিংহের দ্বন্দ্বে নতুন করে ক্ষমতায় আসেন চীনপন্থী মাহেন্দ্র রাজাপাকশে। তার আগের মালদ্বীপের ঘটনা ঠিক উল্টো চীনপন্থী আব্দুল্লাহ ইয়ামিনকে ঠেকাতে ভারতের প্রচ্ছন্ন আকাঙ্ক্ষায় মোহাম্মদ নাশিদরা গড়েন নতুন রাজনৈতিক জোট বন্ধন। চীন-ভারতের এই রাজনৈতিক খেলা কতদূর গড়াবে, বা এরপরের গন্তব্য কোথায় তা সময়ই বলে দিবে তবে ক্ষমতায় আসার এই বিদেশী আশীর্বাদ নীতি ও স্বার্থের প্রশ্নে পরগৃহে অযাচিত হস্তক্ষেপ আমাদের নতুন করে ফেলে আসা সাম্রাজ্যবাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিনা তা ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রাখে।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।