নোবেল জয়ের খবর পেয়ে কার প্রতিক্রিয়া ছিল কেমন?
২০১৯ সালের কথা। ভোর পাঁচটায় হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে জেগে ওঠেন কানাডিয়ান-আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিম পিবলস। তখন তার বয়স ৮৪ বছর। 'আগের অভিজ্ঞতা অনুসারে, রাতের ওই সময় একমাত্র খারাপ খবরের ফোনকলই আসে,' বলছিলেন তিনি। কিন্তু সেদিন তিনি পেয়েছিলেন এক দুর্দান্ত খবর।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, 'নোবেল কমিটি আপনাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করেছে। আপনি কি তা গ্রহণ করবেন?' তিনি তখন ভাবেন, দুনিয়ায় কে এমন আছে, নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে চাইবে না!
সিএনএন'র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি 'বব ডিলান ফিয়াসকো'র ঘটনা উল্লেখ করেন। ২০১৬ সালে বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল ঘোষণা করা হলে সেটি গ্রহণে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। পরবর্তীকালে অবশ্য ২০১৭ সালে পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি।
প্রতিবারের নোবেল বিজয়ী নির্বাচনে নোবেল কমিটি বেশ সতর্কতার সঙ্গে তাদের আলোচনা এবং নির্বাচনের ধাপগুলো গোপন রাখে। এমনকি জনসাধারণের কাছে ঘোষণার মাত্র কয়েক মিনিট আগে বিজয়ীদেরকে এ খবর জানানো হয়।
নিজেরা জানলেও ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ খবর কাউকে জানাতে পারেন না তারা।
গোপনীয়তা রক্ষার এ নিয়ম অনেকের জন্যেই বেশ আবেগীয় হতে পারে। যেমনটি হয়েছিল বেঞ্জামিন লিস্টের ক্ষেত্রে। রসায়নে এবারের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ৫৩ বছর বয়সী এই জার্মান রসায়নবিধ।
'আমার জন্য এটি ছিল বেশ আশ্চর্যের ঘটনা। এ অভিজ্ঞতা আমি কখনোই ভুলব না,' বলেন তিনি।
অন্যদিকে, তার সঙ্গে যৌথভাবে নোবেলজয়ী ডেভিড ম্যাকমিলান বলেন, 'ফোন বেজে ওঠার শব্দে আমার দিকে চিৎকার করে ওঠে আমার স্ত্রী। ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার।' তবে সেদিন ফোনটি রিসিভ করতে পারেননি ডেভিড। ভোরবেলা হওয়ায় আবারও ঘুমিয়ে পড়েন ৫৩ বছর বয়সী এই স্কটিশ রসায়নবিধ।
অনেকের কাছেই নোবেল পুরস্কার জেতা অবশ্য এক অভাবনীয় ব্যাপার। ২০০৭ সালে সাহিত্যে নোবেল জয়ী ব্রিটিশ-জিম্বাবুয়ান লেখিকা ডরিস লেসিং'কে সাংবাদিকরা এ খবর দিতে গেলে তাদের সামনেই 'হায় প্রভু' বলে বসে পড়েন তিনি। অপ্রত্যাশিত এ খবর শুনে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। তার বয়স তখন ৮৮ বছর।
নোবেল পুরস্কার জিতে কী অনুভূতি হয়?
নোবেল জয়ের ফোনকল পাওয়ার পর তাদের জীবন বদলে যায়নি- এমনটা বলতে পারবেন খুব কমজনই।
এবার সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহ বৃহস্পতিবার বিবিসিকে বলেন, 'আজকাল প্রায়ই অপ্রাসঙ্গিক কল আসে আমার কাছে। আমি ভেবেছিলাম এটি তেমনই একটি কল।' তাকে পুরস্কারের কথা বলা হলে সেটি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না ভারত মহাসাগরের তানজানিয়ার জাঞ্জিবার দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী ও বর্তমানে যুক্তরাজ্যে জীবনযাপন করা ৭২ বছর বয়সী এই ঔপন্যাসিক। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ফোন কলারের সঙ্গে কথা বলার পর অবশেষে তা বিশ্বাস করেন গুরনাহ।
তবে অনেক ক্ষেত্রেই বিজয়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা মোটেও সম্ভব হয় না। অনেকেই সংবাদমাধ্যমের খবর, তাদের পরিবার, এমনকি প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও জয়ী হওয়ার সংবাদ জানতে পান।
আমেরিকান অর্থনীতিবিদ পল মিলগ্রোম তার নোবেল জয়ের খবর জানতে পান সহকর্মী রবার্ট উইলসনের কাছ থেকে। ঘটনাটি গত বছরের। মধ্যরাতে পলের বাড়িতে এসে তাকে এ খবর জানিয়েছিলেন রবার্ট।
গত বছরের অক্টোবরে সহকর্মীদের সঙ্গে জুম মিটিংয়ে থাকা অবস্থায় ফোন আসে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী রেইনার্ড গেঞ্জেলের। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন তিনি। অনেকের মতো তিনিও এ খবর শুরুতে বিশ্বাস করতে পারেননি। তাকে বলা হয়, ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য কাউকে এ খবর জানাতে পারবেন না তিনি। মিটিং রুমে গিয়ে তার সহকর্মীদের টিভি চালু করতে বলছিলেন সে সময়ে ৬৮ বছর বয়সী গেঞ্জেল।
এ তালিকায় রয়েছেন সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ১৭ বছর বয়সে নোবেলজয়ী পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাইও। ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে একটি স্কুলে ক্লাসে থাকা অবস্থায় তার শিক্ষকের কাছ থেকে নোবেল পাওয়ার খবর জানতে পারেন তিনি।
তবে সব ক্ষেত্রেই যে বিজয়ীরা রোমাঞ্চিত হন, তা নয়। আমেরিকান গীতিকবি ও গায়ক বব ডিলান এবং তার স্বদেশি কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে- দুজনেই নোবেলের বার্ষিক ভোজ এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য এ তালিকায় বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছেন ডরিস লেসিং। ২০০৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পান তিনি। মুদির দোকান থেকে ফেরার পথে পুরস্কারের খবর জানতে পান তিনি।
নোবেল নিয়ে তার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি ইউরোপের সব কয়টি পুরস্কারই জিতেছি। এখন কি আমার রোমাঞ্চিত হওয়া বা আনন্দবোধ করা উচিত?'
'রকস্টারের মতো আচরণ করা হয়েছিল আমার সঙ্গে'
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর থেকেই সারা বিশ্বের টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছিল গেঞ্জেলের ছবি।
'একবার ঘোষণা হয়ে গেলে আপনি আধা ঘণ্টার মধ্যে আপনার পূর্বের পরিচয় হারিয়ে ফেলবেন,' বলেন তিনি।
তার পাশাপাশি পিবলসেরও একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ফোনকলের কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাড়িতে ভিড় জমান ফটোগ্রাফারেরা।
ঘোষণা পরবর্তী সময়ে এই দুই বিজয়ীর জীবনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। যেমন, একটি লেট-নাইট জার্মান টিভি শো-তে রাজনীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গেঞ্জেলকে।
এদিকে, পৃথিবীর অনেক প্রান্ত থেকে ই-মেইল আসতে থাকে পিবলসের কাছে। সেইসঙ্গে আসতে থাকে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের অনুরোধ।
তবে নোবেল পুরস্কার জয়ের ফলে বিজয়ীদের ব্যক্তিগত সম্পর্কও প্রভাবিত হতে দেখা যায়। 'অনেকেই আমাকে সাধুবাদ জানাতে আসবেন। কিন্তু আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই ভাবতে পারেন, আমি আসলে পুরস্কারটি কেন পেলাম,' বলছিলেন গেঞ্জেল।
অন্যদিকে পিবলস বলেন, 'আমার সঙ্গে একজন রকস্টারের মতো আচরণ করা হয়েছিল। এ এক বিচিত্র সম্মান।'
-
সূত্র: সিএনএন