‘এই বাংলাদেশকে সুখী পরিবার মনে হচ্ছে’
এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কেমন করবে বাংলাদেশ? এমন প্রশ্নে নানা জনের নানা মত। অভিজ্ঞ-তারুণ্যের মিশেলে গড়া দলটিকে নিয়ে অনেকেই আশার বেলুন ফোলাচ্ছেন। কেউ আবার প্রত্যাশার সীমানাটা বাস্তবতার মাপকাঠিতেই মাপছেন। তবে মাশরাফি বিন মুর্তজা এবারের দল নিয়ে দারুণ আশাবাদী। তার বিশ্বাস বাংলাদেশ ভালো করবে এবং সফরটা হতে পারে সেমি-ফাইনাল পর্যন্তও।
বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ ৮৮টি ওয়ানডে ও ২৮টি টি-টোয়েন্টিতে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক এই অধিনায়ক আশাবাদী দলের শারীরিক ভাষা দেখে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর এই দলটিকে অনেক সুখী পরিবার মনে হচ্ছে তার কাছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা, ইতিবাচক দিক, শক্তির জায়গাসহ অনেক বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন মাশরাফি। টিবিএস বিশ্বকাপ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাক্ষাকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
টিবিএস: বিশ্বকাপ দল কেমন হয়েছে? কতোটা আশাবাদী?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: দল বেশ ভালো হয়েছে। আশা তো সব সময় দেখতে হবে। এটা নির্ভর করছে আমরা মাঠে কেমন খেলি। প্রথম রাউন্ড পার হয়ে আমাদের সুপার টুয়েলভে যেতে হবে। আশা করছি ভালোভাবে সুপার টুয়েলভে গিয়ে ওখানেও ভালো পারফর্ম করব আমরা।
টিবিএস: বাস্তবসম্মত চিন্তা করলে বাংলাদেশের কতো দূর যাওয়ার সম্ভাবনা দেখেন?
মাশরাফি: কত দূর যাওয়ার আশা করছি, এভাব বলা খুব কঠিন। তবে দল নিয়ে আমি অবশ্যই আশাবাদী। আমার প্রত্যাশা বাংলাদেশ ভালো খেলবে এবং অন্তত সেমি-ফাইনাল খেলবে। এতটুকু আশা করতেই পারি।
টিবিএস: আইপিএলে একেবারে খারাপ রান হয়নি, এখানেই বিশ্বকাপ। সেই বিবেচনায় মিরপুরের উইকেটে খেলে কতোটা প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়েছে?
মাশরাফি: আমি দেখছি না যে আইপিএল খুব বেশি রান হয়েছে। আইপিএলে এবার সেভাবে রান হয়নি। ভারতে খেলা হলে যেমন ১৮০-৯০, ২০০ পর্যন্ত রান হয়, এখানে ১৫০-৬০ হয়েছে। দুই-একটা খেলায় ১৭০ গিয়েছে। মিরপুরের উইকেটে খেলে প্রস্তুতির কথা বললে বলব, আমাদের হাতে যা আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। অন্য জায়গায় গিয়ে তো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। মিরপুরের উইকেটে আমরা বড় দুটি সিরিজ জিতেছি, এতে খেলোয়াড়দের মনোবল ভালো থাকবে। আমি মনে করি এই দুটি সিরিজ জয় এবং যতুটুকু অনুশীলন হচ্ছে, অতটুকুর ওপরই খেলোয়াড়দের বিশ্বাস আছে। আমার বিশ্বাস ওরা ভালোই করবে।
টিবিএস: বলা হয় টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটসম্যানরা ম্যাচ জেতান, বাংলাদেশের বেলায় প্রায়ই তার উল্টোটা হয়। বোলিং দিয়ে বিশ্বকাপের মতো আসরে জেতা সম্ভব?
মাশরাফি: এটা পুরোপুরি ঠিক নয়, বোলাররাই ম্যাচ জেতায়। সবাই ভাবে টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যানদের খেলা, অবশ্যই এটা ঠিক আছে। একই সঙ্গে টি-টোয়েন্টি বোলাদের খেলাও। বোলাররা যদি কম রানে প্রতিপক্ষকে আটকে রাখে, ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ হয়ে যায়। দুই বিভাগেরই কাজ সমান, বোলিংকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী খেলে। আমাদের শক্তির জায়গা যদি বোলিং হয়, তাহলে বোলিং নিয়েই সামনে এগোতে হবে। টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যানদের খেলা কিনা; এটা আসলে দলের ওপর নির্ভর করে। এটা দেখতে হবে কে কোথায় সুবিধা নিতে চায়।
টিবিএস: মাহমুদউল্লাহ ছাড়া বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানই রানে নেই। হোক সেটা উইকেট বা অন্য কারণে। বিশ্বকাপে গিয়ে ব্যাটসম্যানরা ফর্ম ফিরে পাবেন, এমন আশা করাটা কি বাড়াবাড়ি?
মাশরাফি: এটা 'ডিফরেন্ট বল গেম'। সবাই ফর্মে নেই, এটা বলা ঠিক হবে না। কারণ মিরপুরের যে উইকেটে খেলা হচ্ছিল, রান করা সত্যিই কঠিন ছিল। এরচেয়ে হাজারগুণ ভালো উইকেট থাকবে আরব আমিরাতে। আমি আগে বলেছি রান হচ্ছে না, তবে এত কমও হচ্ছে না। ১৫০-৬০ রান হচ্ছে। বিশ্বকাপে আরও ভালো উইকেট বানানোর চেষ্টা করবে নিশ্চয়ই। করোনা পরিস্থিতির কারণে উইকেটের যত্ন সেভাবে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটা মাঠে এতগুলো ম্যাচ হওয়াতে উইকেট ম্যানেজ করা কঠিন হয়েছে কিউরেটরদের জন্য। এই কারণে উইকেট একটু ড্যাম থাকছে, বল স্লো হচ্ছে; বোলাররা সুবিধা পাচ্ছে। এদিক থেকে আমাদের সাকিব আছে, রিয়াদ ফর্মে আছে, মুশফিক, লিটন, সৌম্য, নাঈম আছে। লেট মিডল অর্ডারে আফিফ ভালো ব্যাটিং করছে, সোহানও ভালো করছে। অলরাউন্ডার হিসেবে সাইফউদ্দিন আছে। সবাই মিলে এক সাথে পারফর্ম করতে হবে। সেই কাজটা করে ন্যূনতম একটা স্কোর দাঁড় করাতে পারলে ভালো কিছুই হবে।
টিবিএস: শেষের দিকের কয়েকটি ম্যাচটি বাদ দিলে আইপিএলে মুস্তাফিজ ভালো বোলিং করেছেন। এই উইকেটে মুস্তাফিজ বাংলাদেশের ট্রাম কার্ড হতে পারেন কিনা?
মাশরাফি: কোন উইকেটে খেলা, সেটা বিষয় নয়; শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী মুস্তাফিজ আমাদের সেরা বোলার। যেকোনো উইকেটেই সে আমাদের জন্য ট্রাম কার্ড। মুস্তাফিজ আমাদের সেরা বোলার, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কোন উইকেটে খেলা, ভাবনার বিষয়ে মুস্তাফিজের ক্ষেত্রে এসব আনার কোনো সুযোগ নেই।
টিবিএস: তামিম ইকবাল নেই, কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে?
মাশরাফি: তামিম ইকবাল খুবই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। তাকে দল মিস করবে না, এটা বল যাবে না। তবে সে যেহেতু নিজেই বিশ্বকাপ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখানে কারও কিছু করার নেই। তবে নিঃসন্দেহেই বলা যায়, বিশ্বকাপে দল তাকে মিস করবে।
টিবিএস: তামিমের অনুপস্থিতির পরও উদ্বোধনী জুটি নিয়ে কতোটা আশাবাদী?
মাশরাফি: উদ্বোধনী জুটি নিয়ে অবশ্যই আমি আশাবাদী। লিটন-সৌমরা অনেকদিন ধরেই খেলছে। সাথে নাঈমও আছে। আমি বিশ্বাস করি টি-টোয়েন্টি তরুণদের খেলা। তারা যদি উপভোগ করে, ভালো করবে।
টিবিএস: তরুণ বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন দলে, ছয়জন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলছেন। অনভিজ্ঞতা দুর্বলতার কারণ হতে পারে কিনা?
মাশরাফি: একটু আগেই বললাম, টি-টোয়েন্টি তরুণ ক্রিকেটারদের খেলা। তো এতো চিন্তার কিছু নেই। টিম ম্যানেজমেন্ট কাছে থেকে দেখছে, যাদেরকে আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে; তাদেরকেই বিশ্বকাপ দলে নেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞতা ভালোই আছে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে নতুনদের সুন্দর সংমিশ্রণ হয়েছে। রিয়াদ, মুশফিক, সাকিব আছে। লিটন-সৌম্যরা অনেক দিন থেকে খেলছে। কয়েকজন আছে, যারা প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলছে। আমি নিশ্চিত তারাও মাঠে উপভোগ করবে, সিনিয়ররা তাদের চাপ কমিয়ে দেবে। মাঠে তাদের সাথে সিনিয়ররা অনেক কথা বলবে, তাহলে সহজ হয়ে যাবে।
টিবিএস: তরুণদের মধ্যে কাদের বিশ্বকাপে ভালো করার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন এবং কেন?
মাশরাফি: নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড়কে বেছে নেওয়ার পক্ষপাতী আমি নই। ১৫ জনের স্কোয়াড, করোনাকাল হওয়ায় আরও একজন বেশি আছে। পুরো স্কোয়াডের প্রতি আমার শুভকামনা থাকবে। যেই ভালো করুক, তার পরিচয় সে বাংলাদেশি। নির্দিষ্ট কারও ওপর নির্ভরতায় আমি বিশ্বাসী নই।
টিবিএস: অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয় বিশ্বকাপে কতোটা ভূমিকা রাখতে পারে?
মাশরাফি: এই দুটি সিরিজ জয় অবশ্যই আমাদের আলাদা আত্মবিশ্বাস দেবে। আমদেরকে সাহসী করে তুলবে। এতো বড় দলের বিপক্ষে জেতাটা সব সময়ই অনুপ্রেরণার।
টিবিএস: এমন দুটি দলকে হারানোর পর কি বলা যায়, বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে মোটামুটি ভালো দল এখন?
মাশরাফি: হারালেই যে বড় দল হেয়ে গেলাম, এটা বলা ঠিক হবে না। এতে দলের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। ধারাবাহিকতার ওপর নির্ভর করে আপনি দল হয়ে উঠেছেন। আমি মনে করি ভালো দল হয়ে উঠছি, ধারাবাহিকতা বাড়বে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে। ভালো দল হয়ে উঠেছি, এত দ্রুতই সেটা বলঅ সম্ভব নয়।
টিবিএস: পারফরম্যান্সে বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে, এমন দুজন ক্রিকেটারের কথা বলা হলে কাদের নাম বলবেন?
মাশরাফি: আমি আগেই বলেছি যে, নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে বাছাই করে তার ওপর ভরসা করে দল এগিয়ে যাবে; এটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা হতে পারে না। সবাইকে নিয়ে আশাবাদী থাকতে হবে। দল যখন ভালো ফল করছে, কে ভালো করছে, সেটা মূখ্য নয়। দল ভালো করছে কিনা, এটাই বিষয়। নির্দিষ্ট কাউকে বেছে নেওয়ার পক্ষে আমি নই।
টিবিএস: এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবেচেয়ে ইতিবাচক দিক কোনটি?
মাশরাফি: আমার কাছে মনে হয় এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দিক, এই দলটাকে অনেক সুখী পরিবার মনে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত বড় বড় দুটি সিরিজ জিতেছে। খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষা বলছে, তারা বেশ আত্মবিশ্বাসী। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তরুণ ক্রিকেটাররা দায়িত্ব নিয়েছে। এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক দিক।
টিবিএস: আর নেতিবাচক?
মাশরাফি: আমি মনে করি না এসব বেশি তুলে ধরা ভালো। দল বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে, নিজেদের মতো করে খেলুক। আর দুটি সিরিজ জেতার পর নেতিবাচক ব্যাপার খুঁজে বের করাও কঠিন। থাকলেও সেসব খুঁজে বের করার কারণ আমি দেখি না। কারণ একটা দল যখন বিশ্বকাপে যাচ্ছে, তখন যত ইতিবাচক বিষয় নিয়ে বলা যায়, ততো ভালো। যতো ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিশ্বকাপে খেলবে ততো ভালো আমাদের দলের জন্য।
টিবিএস: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সব কটি আসরে খেলেছেন আপনি। এই প্রথম আপনাকে ছাড়া বিশ্বকাপ খেলবে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে অবসর নিলেও মিস করবেন?
মাশরাফি: না, একদমই মিস করব না। কারণ কোনো না কোনো সময়ে এটা হতোই। কোনোদিন হতো না, এমন তো নয়। জীবনে যেটা অবধারিত, সেটাকে মিস করা বা তা নিয়ে আপসেট থাকার কোনো কারণ নেই। আমার শুভকামনা থাকবে দলের সঙ্গে, যেন দল অনেক ভালো করে এবং দেশের মানুষকে অনেক ভালো কিছু উপহার দেয়।
টিবিএস: বাংলাদেশ দলের জন্য কোনো বার্তা?
মাশরাফি: গুড লাক বাংলাদেশ, অবশ্যই ভালো কিছু হবে।