কক্সবাজার সৈকতে বসে আতিফ আসলামের ‘ওরে পিয়া’ গাইছিলেন ইকবাল
কুমিল্লায় নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ইকবাল হোসেন কক্সবাজার গেছেন গত সোমবার।
এর আগে, বুধবারের ঘটনার পর প্রথম ৫-৬ দিন ইকবাল কুমিল্লা ও আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান পরিবর্তন করছিলেন বলে জানা গেছে কুমিল্লা ও কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে। তবে ইকবাল কীভাবে কক্সবাজার গেছেন, সে বিষয়ে এখনো পুরোপুরি জানতে পারেনি পুলিশ।
ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে যুক্ত থাকা একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ১৩ অক্টোবের ঘটনার পর থেকে পরের ছয়দিন ইকবাল কুমিল্লাতেই ছিলেন। তবে ধীরে ধীরে সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ হতে থাকলে বিষয়টা জানাজানি হওয়ায় কেউ একজন ইকবালকে সতর্ক করে দেয়। তারপর সোমবার কক্সবাজার চলে যান তিনি।
তবে, কীভাবে ও কার ইশারায় ইকবাল কক্সবাজার গেলেন, সেসব তথ্য এখনো খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেছেন, ইকবাল কেন কক্সবাজার গিয়েছিলেন, কেউ তাকে যেতে নির্দেশ করছে কি না, সেটি জানতে তাদের আরো সময় লাগবে।
ইকবালকে সন্দেহ হয় একদিন পরই
পূজামণ্ডপে কোরআন শরীফ রাখা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে প্রথমদিন থেকেই কুমিল্লা জেলা পুলিশের সাথে যোগ দেয় পুলিশের বিশেষ সংস্থা অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিউ) ১৫ জন সদস্য, ঢাকা মহানগর পুলিমের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ৫ জন ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পাঁচজন পুলিশ সদস্য। ১৪ অক্টোবর রাতেই ইকবালকে সন্দেহ হয় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের।
এটিইউর একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'প্রথম দিন থেকে আমরা আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা শুরু করি। পরদিন বৃহস্পতিবার এক পর্যায়ে একটি ফুটেজে একজন ব্যক্তিকে হাতে লম্বাটে কিছু একটা নিয়ে যেতে দেখা যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম লাঠির মতো কিছু হবে। পরে দেখলাম, এটা হনুমান মূর্তির গদা।
'এরপর আমরা পূজা মণ্ডপে হামলার আগে-পরের ফুটেজ দেখা শুরু করি। সেখানেও আমাদের লক্ষ্য ছিল গদা হাতে কাউকে দেখা যায় কি না সেটা খুঁজে বের করা।
'এদিকে, আমরা ফুটেজগুলো ক্লোজ করে আরো পর্যালোচনা করতে শুরু করি, বারবার মিলিয়ে দেখি। ১৪ অক্টোবর শেষমেষ বৃহস্পতিবার রাতেই আমরা ইকবাল যে কাজটি করে থাকতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত হই। এরপর থেকে শুরু হয় ইকবালকে খুঁজে বের করার অভিযান।'
কুমিল্লা জেলা পুলিশের সাথে তদন্তে অংশ নেওয়া আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'ইকবালের বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে তার পরিবারের কাছে যাই আমরা। সেখানে তার মাদকাসক্তি ও কিছুটা পাগলামি স্বভাবের কথা জানতে পারি। এটাও জানতে পারি যে, ইকবাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। এতে করে আমাদের কাজটা আরো জটিল হয়ে যায়। কারণ মোবাইল ফোন না থাকলে এই প্রকৃতির মানুষকে খুঁজে বের করা খুবই দুরূহ কাজ।'
কুমিল্লা জেলা পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'ইকবালের পরিবারের কাছ থেকে তার বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাাবার পর আমরা আরো নিশ্চিত হই। কাছের সুজানগর মসজিদের ভেতরের ফুটেজেও তার ডিগবাজি দেওয়ার ভিডিও পাওয়া যায়। এতে করে পরিবারের কথার সাথে মিল পাওয়া যায়।
'এরপর তার জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সবখানে খবর পাঠানো হয়। সে কুমিল্লা-ফেনী রোডের মদিনা বাস সার্ভিসে কন্ডাক্টরের কাজ করত মাঝে মাঝে, সেখানে খোঁজ নিই। তবে সে নিয়মিত জায়গা বদলানোর কারণে কাজটা কঠিন হয়ে যায়।
'তিন থেকে ৫ জনের একটি করে টিম ভাগ করে ইকবালকে খোঁজার মিশনে নামে পুলিশ। তাকে কক্সবাজারে শনাক্তের আগে ৩৫-৪০টি অভিযান করা হয়, সবখানেই খবর পাওয়া যেত ইকবালকে দেখা গেছে, গিয়ে দেখা মিলত না। এর মাঝে দেশজুড়ে একের পর এক ঘটনা ঘটছিল, যা আমাদের আরে চাপে ফেলে দেয়। সবমিলিয়ে আমাদের গলদঘর্ম হতে হয়েছে এটাই বলা চলে।'
এটিইউর একজন কর্মকর্তা বলেন, তারা ইকবালকে শনাক্ত করতে পূজামণ্ডপে ঢোকার পথগুলোর আশপাশের ১০০-২০০ মিটারেরর মধ্যে থাকা সবগুলো সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা শুরু করেন। মন্দিরে ঢোকার যতগুলো পথ আছে, সবগুলোর ফুটেজ দেখতে হয়েছে।
কক্সবাজারে যেভাবে শনাক্ত
যে তরুণদের দলটি ইকবালকে কক্সবাজারে দেখে পুলিশে যোগাযোগ করেছিল, তাদের দুজনের সাথে কথা হয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের।
পাঁচ বন্ধু মিলে ঘুরতে মঙ্গলবার রাতে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যান চৌমুহনী এস এ কলেজের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুর রহমান অনিক। তিনি টিবিএসকে বলেন, বুধবার বিকেল আনুমানিক সাড়ে চারটার দিকে কলাতলীর দরিয়ানগর বিচে বসে গান শুনছিলেন পাঁচ বন্ধু। তার মুঠোফোনে একের পর এক বাজছিল গান।
আতিফ আসলামের 'ওরে পিয়া' গানটি বাজার সময় পাশ থেকে এক যুবক হঠাৎ করেই তাদের সাথে গলা মেলাতে থাকেন, উচ্চ স্বরে গাইতে থাকেন গানটি। এর পরের কয়েকটি গানেও গলা মেলান লোকটি।
অপরিচিত লোকটি তাদের সাথে গান গাইতে থাকায় কিছুটা ভয় পান অনিকরা। মুঠোফোনের গান বন্ধ করে দেয়ার পরও 'ওরে প্রিয়া' গানটি গাইতে থাকেন ওই যুবক। তখন তাদের আরো সন্দেহ হয়। পরে যুবককে নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে নিজেকে তিনি কুমিল্লার মডেল থানা এলাকার ইকবাল হোসেন বলে পরিচয় দেন।
অনিক বলেন, 'এ সময় লোকটি আমাদের থেকে খাবার খেতে চায়। আবার বলে, "সিগারেট আছে? আমাকে সিগারেট দেন।" পরে আমাদের কাছে বিষয়টা ভালো না লাগায় তার কাছ থেকে সরে আসি।
'বুধবার রাতে হোটেলে আসার পর, ফেসবুকে কুমিল্লার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে পাই। দ্বিতীয় ফুটেজের একটিতে ইকবালের চেহারা কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল, আমরা যে লোকটাকে দেখেছিলাম তার সাথে অনেক মিল আছে। ওইদিন আর বিষয়টি নিয়ে আমরা আর কাউকে জানাতে চাইনি।
'পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আবারও কলাতলী-সুগন্ধা বিচের কাছে একটা জায়গায় লোকটাকে দেখতে পাই। পরে সাথে সাথে আমরা বিষয়টি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানায় জানাই। বেগমগঞ্জ থানায় যোগাযোগ করলে আমাদেরকে ইকবালের সাথে বিস্তারিত কথা বলতে বলা হয়। এর মাঝে ইকবালের সাথে কথা বলতে থাকে বন্ধু মেহেদী হাসান মিশু, সাইফুলসহ বাকিরা। একসময় বেগমগঞ্জ থানা থেকে আমাদের কুমিল্লার পুলিশ সুপারের নম্বর দিয়ে ওনার সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়।'
এরপর নোয়াখালীর কুমিল্লা জেলার এসপি ফারুক আহমেদকে নোয়াখালী এসপি জানান, কয়েকজন তরুণ তাকে ফোন করে জানিয়েছেন যে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ইকবালের মতো একজনকে দেখা যাচ্ছে। এরপর অনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কুমিল্লার এসপি। তাদের বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত যেন ইকবালকে নজরদারিতে রাখেন। পরে কক্সবাজার জেলার পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ইকবালকে আটক করে।
ফারুক আহমেদ অনিকদের বলেন, সম্ভব হলে তারা যেন ইকবালের ছবি ও ভিডিও তাকে পাঠান। অনিকরা ছবি ও ভিডিও পাঠালে সেগুলো ইকবালের পরিবারের সদস্যদের দেখানো হয়। তারা নিশ্চিত করেন যে, ছবির ওই ব্যক্তিই ইকবাল হোসেন।
ইকবাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না বলে তাকে শনাক্ত করতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ম্যানুয়াল সূত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে পুলিশকে।
ইকবালের পরিবার তাকে শনাক্ত করার পর কক্সবাজার পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে ফোর্স পাঠানো হয়। কক্সবাজার পুলিশ আটক করে ইকবালকে। এভাবেই পাঁচ তরুণের সহায়তায় ধরা পড়েন ইকবাল।