ইটভাটা গিলে খাচ্ছে আবাদি জমির উর্বর মাটি
“অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু জমি থেকে মাটিকাটা বন্ধ করতে পারিনি। যারা মাটি কাটেন তারা অনেক প্রভাবশালী। কিছু বললে মামলা-হামলার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।” ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন আবদুল মোত্তালেব।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কদমতলী গ্রামের আবদুল মোত্তালেবের মতো অনেকেই জানান, পার্শ্ববর্তী শাহজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগে ইটভাটার জন্য অবৈধভাবে মাটিকাটা হতো। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছর ধরে জেলার গাবতলী, কাহালু, শেরপুর, ধুনটসহ বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম থেকে ফসলি জমির ‘টপ সয়েল’ বা উর্বর অংশ কাটা হচ্ছে। স্থানীয়দের দাবি, শাহজাহানপুর উপজেলার অন্তত ১৯টি এলাকার ইটভাটার জন্য দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই চলছে মাটিকাটার কাজ।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, অবৈধভাবে কাটা টপ সয়েলের অধিকাংশই ব্যবহৃত হচ্ছে জেলার বিভিন্ন ইট ভাটায়। যদিও মাটিকাটা বন্ধে কার্যকর ভুমিকা নিতে ব্যর্থ হওয়ার দ্বায় স্বীকার করে নিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, অনেক চেষ্টা করেও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এ অবৈধ কাজ তারা বন্ধ করতে পারছেন না।
চোখের সামনে এলাকার অনেক আবাদি জমিতে বড় বড় গর্ত তৈরি হতে দেখেছেন জানিয়ে গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আলী মণ্ডলের ছেলে মো. রয়েত বলেন, “নির্বিচারে যেভাবে মাটি কাটা হচ্ছে তাতে কিছুদিন পর আর আবাদি জমি থাকবে এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, আগে মাটি কাটা হতো দিনের আলোয়, আর এখন রাতেও চলে মাটি কাটার কাজ।’’
শাহজাহানপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রভাষক সোহবার হোসেন ছান্নু জানান, মাটিকাটা বন্ধে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সমন্বয় সভায় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের এ বিষয়ে উদ্যোগী হবার আহ্বান জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
“উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভ্রাম্যমাণ আদালতে কয়েকজনকে সাজা এবং জরিমানাও করেছেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।” যোগ করেন তিনি।
ইট তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে আবাদি জমির উর্বর অংশের মাটি ব্যবহারের ফলে সব ধরনের ফসলের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদরা।
বগুড়ায় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্মকর্তারা বলছেন, জমি থেকে যে উর্বর অংশ কাটা হচ্ছে তার মধ্যে আছে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশ, সালফার ও দস্তাসহ ১৩ ধরনের উপাদান। টপ সয়েল কাটায় এসব মৌলের পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে মাটির প্রাণশক্তি জৈব পদার্থ।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহ মো. গোলাম মওলা জানান, মাটির উর্বর এক ইঞ্চি অংশ তৈরি হতে প্রায় ১০০ বছর সময় লাগে। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে ১০ ইঞ্চি থেকে শুরু করে মেশিনে ১০ ফুট পর্যন্ত মাটি কাটা হয়েছে।
“আমি মনে করি ইটভাটার অনুমতি দেওয়ার আগে মৃক্তিকা সম্পদ বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ বা মতামত নেওয়া হলে মাটি রক্ষা করা সম্ভব হবে।’’
পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক উপ-সচিব মো. আশরাফুজ্জামান জানান, আবাদি জমি থেকে মাটি কাটার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আইন-অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন জেলা/উপজেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয়া হচ্ছে। আবাদি জমি থেকে মাটিকাটার অধিকাংশ অভিযোগই আসছে ইটভাটার বিরুদ্ধে।
“গেজেট অনুযায়ী আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি কাজ শতভাগ হবে ব্লক ইট দিয়ে। আগামী অর্থ বছরের মধ্যে ২০ শতাংশ সরকারি কাজে ব্যবহার হবে ব্লক ইট।”
পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ২১০০ ভাটায় ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে জমির উর্বর অংশ বা টপ সয়েল।
২০১৯ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা হয়েছে- ভাটার অনুমতি পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে ইট তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠান কোন উৎস থেকে মাটি সংগ্রহ করবে। জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষেই চালু করা যাবে ইটভাটা। যদিও উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ ইটভাটা এ আইন মানছে না। অনেক ভাটার কোনো অনুমতিও নেই। কিন্তু জনবলের অভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর দোষী ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। রাজশাহী বিভাগীয় অফিসে ৫৪ জনের স্থানে লোকবল রয়েছে মাত্র ১৩ জন।