বৈরী জলে বাস করা আমাদের ইরাবতী ডলফিনের গল্প
বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির অগভীর অংশে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম আমরা। প্রখর রোদের নিচে তালিকা তৈরি করছিলাম আর মাছ ধরার নৌকার ওপর জরিপ চালাচ্ছিলাম। কিন্তু হতাশার পারদ বেড়েই যাচ্ছিল।
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে তেমন কোনো বৈচিত্র্যই দেখতে পাইনি আমরা, একটি হাঙ্গর বা রে মাছের দেখা পর্যন্ত পাইনি। বড় বড় লেন্স নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু ছবি তোলার মতো পাখিও দৃষ্টিসীমানায় ছিল না।
হেলান দিয়ে বসে বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত, অস্পষ্ট ও বাদামীরঙা মোহনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। ডলফিনের দেখা পাওয়ার আশা নিয়েই বসে ছিলাম।
"একটা বড় মাছ ধরা পড়েছে, নিজেকে মুক্ত করতে জালে ঝাপটাচ্ছে," আমার বামপাশে পানির দিকে দেখালো একজন। আমি সেদিকে তাকাই।
সূর্যের আলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সবকিছুই সিলোয়েটের মতো লাগছিল। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল এভাবেই। তারপরই আমি এটি দেখতে পাই, পানির ঘূর্ণিঝড়, জলের ঝাপটা, মাছ নয় ডলফিন এটি!
পরবর্তী আধা ঘণ্টা ধরেই আমরা উত্তেজনায় ছুটোছুটি করতে থাকি। সবাই স্টারবোর্ডের দিকে ছুটছিল, চিৎকার করছিল, সেইসঙ্গে নিজেদের ক্যামেরা বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
নীলচে-ধূসররঙা ডলফিনগুলো মাছ ধরছিল, সন্তর্পনে মাছ ধরার জাল এড়িয়ে যাচ্ছিল। চিত্তাকর্ষক দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ হয় আমাদের। একটি বাচ্চা ডলফিন অবিরাম আয়েশি ভঙ্গিতে তার লেজ নাড়াচ্ছিল।
আমাদের কাজও আরও সহজ হয়ে যায়। নিজেদের উত্তেজনা চাপা দিয়ে ফটোশুটের জন্য প্রস্তুত হই। তখনই আমাদের থেকে কয়েক ফুট দূরেই চারটি ডলফিনের একটি দল দেখতে পাই।
এগুলোই ছিল ইরাবতী ডলফিন।
উপকূল থেকে নদীতে
ছোট চঁচুবিশিষ্ট, ভোঁতা আকৃতির মাথার ছোট পাখনার এ ডলফিনগুলো লবণাক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে, উপকূলীয় জলরাশি থেকে নদীর মোহনা পর্যন্ত এদের বাস।
বঙ্গোপসাগরের উপকূল, আন্দামান সাগর ও থাইল্যান্ডের উপসাগর জুড়ে ছড়িয়ে আছে এ ডলফিনগুলো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি উল্লেখযোগ্য নদী ইরাবতী ও মেকংয়েও তাদের দেখা মিলবে। ইরাবতী নদীর নামেই ডলফিনগুলোর নাম রাখা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছাড়াও, ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অগভীর পানিতেও দেখা যায় তাদের। লোনা পানির হ্রদেও ইরাবতী ডলফিনের উপস্থিতি দেখা যায়। পূবদিকে গেলে পালাওয়ান দ্বীপ পর্যন্ত দেখা মিলবে ইরাবতীর।
বাংলাদেশে ইরাবতী ডলফিন সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সুন্দরবন ও গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সম্মিলিত অববাহিকার একদম দক্ষিণে।
বৈশ্বিকভাবেই বিপন্ন, নেই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ডলফিনের এ প্রজাতিকে বিপন্ন ঘোষণা করেছে। গত ১০ বছরে প্রজাতিটির জনসংখ্যা অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ কমেছে।
গিলনেটিং ইরাবতী ডলফিনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকির কারণ। এই জালগুলো উলম্বভাবে পানিতে ফেলা হয়, মুক্তভাবে পাক খায়।
এর ফলে এই বেশালদেহী স্তন্যপায়ীও নেটে জড়িয়ে ডুবে যায়। গিল নেটিং ছাড়াও, যন্ত্রচালিত নৌকার প্রপেলারে আঘাত পাওয়ার ঝুঁকিতেও থাকে ডলফিনগুলো।
এক সময় মেকং ও ইরাবতীতে এই ডলফিনগুলোই জেলেদের জন্য মাছ জমিয়ে রাখতো। প্রযুক্তির আবির্ভাবের সঙ্গে পারস্পরিক এ সম্পর্কও হারিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ থেকেও অনেক আগেই এ বিশ্বাস হারিয়ে গেছে। গত দুই দশক ধরে এশিয়ান জলরাশিতে মাংস ও তেলের জন্য নৃশংসভাবে ডলফিন হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ডলফিনের মৃত্যু যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি এখন। ২০১৭ সাল থেকে 'সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশ' ৩০০টি ডলফিনের মৃত্যু লিপিবদ্ধ করেছে। পটুয়াখালী থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত উপকূলজুড়ে বেশ কিছু প্রজাতির ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে উঠেছে।
বেশ কিছু দেশ ডলফিনের সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে। কম্বোডিয়ায় গিল নেট ব্যবহার নিষিদ্ধ। মিয়ানমারে গিল নেটের ব্যবহার কিছু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিছু নির্দিষ্ট আকারের জালের ওপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। গিল নেট থেকে ডলফিনদের বাঁচাতে আমাদের দেশে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। ডলফিনের হতাহতের কোনো অফিসিয়াল হালনাগাদকৃত তথ্যও নেই।
লাওসে বাকি মাত্র তিনটি, আমাদের কয়টি?
লাওসে ইরাবতী ডলফিন বিলুপ্তই হয়ে গেছে বলা যায়। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউএফ) ২০১৬ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, মেকংয়ের লাওসের অংশে মাত্র তিনটি ইরাবতী বেঁচে আছে।
ডব্লিউডব্লিউএফ কম্বোডিয়ার ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মেকংয়ের দক্ষিণেও এদের সংখ্যা একশোর নিচে। ২০১৮ সালের ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) হিসাব অনুযায়ী, ইরাবতী নদীতে ইরাবতী ডলফিন বাকি আছে মাত্র ৭৮টি। পালাওয়ানে এ সংখ্যা মাত্র ৩৫।
বাংলাদেশের উপকূলীয় জলরাশি ও আন্তর্জাতিক জলভাগের ওপর ২০০৬ সালে একটি বিস্তারিত জরিপ চালানো হয়, জার্নাল অব সেটেশন রিসার্চ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় এটি। সেই জরিপে বিস্ময়কর এক তথ্য উঠে আসে। বাংলাদেশে তখন ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩৮৩টি।
বেশ কয়েক বছর আগে ডব্লিউসিএসের চালানো আরেকটি জরিপে বাংলাদেশের সুন্দরবনের এ প্রজাতির সংখ্যা কতো তা জানা যায়। ২০০৬ সালে মেরিন ম্যামাল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সুন্দরবনে ৪৫১টি ইরাবতী ডলফিন আছে বলে উল্লেখ করা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই সিস্টেমেটিক সার্ভের পরিসংখ্যানিক মডেলিংয়ের ভিত্তিতে এ সংখ্যা অনুমান করা হয়।
এ আবিষ্কারের পর ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে কয়টি ডলফিন বাকি আছে?
২০১৯ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডলফিন অ্যাকশন প্ল্যানের ২০২০-৩০ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে ১৯৮টি ইরাবতী ডলফিন আছে। বনের নদীগুলোর ১৩৪০ কি.মি. অঞ্চলে চালানো জরিপে এ সংখ্যা উঠে এসেছে।
বরগুনা ও পটুয়াখালীর নদীতে আরও ৩০টি ডলফিন পাওয়া গেছে। নিঝুম দ্বীপ মেরিন রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ২০১৭-২০৩৪ এর ড্রাফটে বলা হয়েছে, নিঝুম দ্বীপের জলসীমায় ৯৩টি ইরাবতী আছে।
এ প্রতিবেদনে আরও দুটি পরিসংখ্যানের উল্লেখ আছে। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ এর জরিপের ওপর ভিত্তি করে ডব্লিউসিএস বাংলাদেশ ৪৮৫টি ইরাবতী ডলফিনের খোঁজ পেয়েছে।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশেই এ প্রজাতির সবচেয়ে বেশি সদস্যের বাস। কিন্তু কয়েক বছরে কি এ সংখ্যা কমেছে? নাকি যে মডেলে এ সংখ্যা বের করা হয়েছিল তাতে ভুলের কারণে বেশি সংখ্যা এসেছিল? কোথায় গেল এতোগুলো ডলফিন?
মঙ্গাবে-কে ২০০৮ সালের গবেষণার প্রধান গবেষক ও বাংলাদেশে ডলফিন গবেষণার পথিকৃৎ ড. ব্রিয়ান স্মিথ বলেন, "এ আবিষ্কার আমাদের আশা যোগায়, ইরাবতী ডলফিনেরও ভবিষ্যত আছে। ইরাবতী ডলফিনের গুরূত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ।"
লাফালাফি করতে থাকা ডলফিনগুলো কিছুক্ষণ পর আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমাদের নৌকা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় দিগন্তে নৌকাগুলোকে ছোট বিন্দুর মতো মনে হচ্ছিল, পানির উপরিভাগ সাগরে ফেলা গিলনেট ভাসমান গিলনেটে আচ্ছাদিত মনে হচ্ছিল। এরমধ্যে ডলফিনের জায়গা কোথায়?
- লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ও বন্যপ্রাণি গবেষক।
- ভাষান্তর: রাফিয়া তামান্না