রপ্তানিতে ৬০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অক্টোবরে
৪৭২ কোটি ডলার অর্জন করে গত অক্টোবরে একক মাসে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয়ের রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। যার পেছনে শক্তিশালী অবদান রেখেছে পশ্চিমা দেশে আসন্ন উৎসবকালীন মৌসুম উপলক্ষে ভোক্তা চাহিদা বৃদ্ধি এবং পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোয় নতুন করে কোভিড সংক্রমণের কারণে দেখা দেওয়া সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা।
ফলে এই মাসে ৩৪৬ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে রপ্তানি আয়। বছরওয়ারি হিসাবে যা বড় মাত্রায় বা ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে।
মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্যসূত্রে এসব জানা যায়।
বছরওয়ারি হিসাবে অক্টোবরে পোশাক পণ্যের জাহাজিকরণ ৫৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ার ফলে; চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি আয় ১ হাজার ৫৭৪ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
অক্টোবরে অর্জিত আয় ছিল সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।
চামড়া, কৃষি, মাছ, ওষুধ এবং প্লাস্টিক পণ্যেও বছরওয়ারি হিসাবে চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে পাট এবং পাটজাত পণ্যে তা হয়নি, এখাতে অক্টোবরে নেতিবাচক ৮ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা জানিয়েছে ইপিবি।
পোশাক রপ্তানিকারকরা আগামী কয়েক মাসে রপ্তানি বৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদী হলেও, কাঁচামাল ক্রয়ের ঊর্ধ্বমুখী খরচের তুলনায় পোশাকের প্রতি ইউনিটের কম দাম নিয়ে চিন্তিত।
দেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, 'ভারত ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশে কোভিড-১৯ জনিত রপ্তানি বিচ্ছিন্নতা, মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং চীনে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে দেশের পোশাক খাতে কার্যাদেশ বেড়েছে, ফলে আমরা রপ্তানিতেও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করছি।'
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি আরও বলেন যে, পোশাক শিপমেন্ট বেড়েছে কারণ স্থগিত এলসি শিপমেন্ট থেকে ভাল পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়েছে, যেগুলি কোভিড -১৯ এর কারণে স্থগিত করা হয়েছিল।
'তবে এটি আত্ম-সন্তুষ্টির বিষয় নয় কারণ এর ধারাবাহিকতার জন্য আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে,' যোগ করেন তিনি।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক টিবিএস'কে বলেন, 'অক্টোবরে রপ্তানিতে এই রেকর্ড প্রবৃদ্ধি পশ্চিমা উন্নত দেশগুলির শক্তিশালী পুনরুদ্ধারকে প্রতিফলিত করে। এর আগে, মহামারির সৃষ্ট দুর্বল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে এসব বাজারে পণ্যের চাহিদা দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে ছিল।'
লকডাউনের মতো চলাচলের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর এসব দেশে মানুষের চলাচল ও স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। বেড়েছে সশরীরে অফিসে যোগদান ও পর্যটন। দুটি ঘটনাই বাংলাদেশ পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মতো যেধরনের পণ্য রপ্তানি করে তার চাহিদা বৃদ্ধি করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
'দীর্ঘদিন এসব পণ্যের চাহিদা স্থবির থাকায়, এসব কিনতে ভবিষ্যতে ভোক্তাদের বেশি খরচ করার প্রবণতাও থাকবে। তাছাড়া, উন্নত দেশের সরকার ঘোষিত বড় অংকের প্রণোদনামূলক সহায়তাও বৈদেশিক চাহিদার স্ফীতিকে সমর্থন করছে। এসব বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপও পণ্যের দাম বাড়িয়েছে।'
যাইহোক, গত বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুব একটা অর্থবহ নয়, কারণ মাঝে মাঝে পুনরুদ্ধার বেশ ক্ষীণ ছিল, বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ড. আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, 'আগামী মাসগুলোয় উদার প্রণোদনামূলক সহায়তার ফলে সৃষ্ট এই উচ্চ খরচের প্রভাব কমা শুরু করলে, বর্তমান প্রবৃদ্ধি স্বল্প স্থায়ীও হতে পারে। তাছাড়া, শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার থেকে উপকৃত হচ্ছে। যেমন- চীন সেপ্টেম্বরে ৩০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।'
তবে চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে অতি-উদ্যমী যুক্তরাষ্ট্র, ফলে খুব শিগগির চীনের রপ্তানি ব্যাপক চাপের মুখে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বাজার অংশীদারিত্বে ভাগ বসাতে এটাই বাংলাদেশের জন্য সুযোগ, বিশেষত পোশাক খাতে চীনের রপ্তানি নিশ্চিতভাবেই কমতে চলেছে- বলে জানান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. রাজ্জাক।
জুলাই-অক্টোবরের আয় গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্জিত ১২.৮৪ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি এবং নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বা ২.০৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে নিট পোশাকের চালান জাহাজিকরণ থেকে, অন্যদিকে উভেন আইটেমে আয় হয় ১৫১ কোটি ডলার। উভয় উপ-খাতেই গত বছরের চেয়ে ৫২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।
বিদেশি অনেক বায়ার পণ্য পাঠানোর ১৮০ দিন পর মূল্য পরিশোধ করেন। ফলে দেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা চলতি মূলধন সংকটে রয়েছে, যা আগামী দিনগুলোতে নির্ধারিত সময়ে চালান পাঠানোর ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করবে বলে জানান বিজিএমইএ সহ-সভাপতি ।
অন্যদিকে, পোশাক প্রস্তুতের কাঁচামালের দামও চড়েছে বিশ্ববাজারে, কিন্তু তার সাথে রপ্তানিকারকদের ঋণ সীমা সমন্বয় করা হয়নি। এই অবস্থায় 'ব্যাংকগুলি ঋণ সীমা না বাড়ালে আগামী দিনগুলোয় আমরা টেকসইভাবে ব্যবসা ধরে রাখতে পারব না,' বলে মন্তব্য করেন আজিম।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচাল্ক (এমডি) শোভন ইসলাম বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা ক্রিসমাস উপলক্ষে এবং শীত ও শরৎকালীন চাহিদা পূরণে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি পোশাক কিনেছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এসব দেশের অর্থনীতি ও বিপণী কেন্দ্রগুলো সচল হচ্ছে। বেশিরভাগ প্রতিযোগী দেশ মহামারির কারণে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় বাংলাদেশ ক্রেতাদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সোর্সিং হাব হয়ে উঠেছে।
চলতি নভেম্বর ও আগামী ডিসেম্বরেও পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে শোভন ইসলাম বলেন, সাধারণত বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমের পোশাকের চালান ডিসেম্বরের শেষদিক থেকেই পাঠানো শুরু হয়। তবে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে সমস্যার কারণে বিদেশি বায়াররা আগেভাগেই চালান পেতে চাইছেন, ফলে চলতি বছর নভেম্বর থেকেই তা শুরু হবে।
তিনি আরও জানান, সুতার দাম বাড়ার আগেই নির্ধারিত মূল্যে রপ্তানির কারণে অক্টোবরে পাঠানো চালানে ভালো দাম পাওয়া যায়নি। তবে এরপরের অর্ডারগুলোর জন্য তারা এখন ভালো দাম পাচ্ছেন। এসব অর্ডারের বেশিরভাগই প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়েছে।
স্প্যারো গ্রুপ এমডি বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু খরচ ৫ থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে, একইসময়ে গার্মেন্টস উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩-৪ শতাংশ।
'তবে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত চালানে অতিরিক্ত মূল্য পাওয়ার বিষয়ে আমরা এখন ক্রেতাদের কাছ থেকেও ইতিবাচক নোটিশ পাচ্ছি,' যোগ করেন শোভন।