দ্য পটেটো ইটার্স
একটি অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল ছবি। টেবিলের চারদিকে জমায়েত পাঁচজন মানুষ। তাদের খাবারের পাতে আলু, পানপাত্রে কফি। শিল্পীর লেখা চিঠি থেকেই জানা যায়, নামকরণের সার্থকতা ধরে রাখতে ছবির চরিত্রগুলোকেও এমনভাবে আঁকা হয়েছে, যেন তারা দেখতে ধুলোমাখা আলুর রঙের মতোই, যাদের খোসা ছাড়ানো হয়নি এখনো। এই মানুষগুলোর হাতে দিনভর পরিশ্রমে কড়া পড়েছে, মুখম-ল কঠোর, চোখ গভীর কালো আর তাতে যেন অভিব্যক্তিগুলো ঠিকরে বেরোচ্ছে।
শিল্পীর সাফল্য তার সমঝদারের মুখাপেক্ষী অবশ্যই, কিন্তু কেমন হয়, যখন শিল্পীর নিজের পছন্দ আর গুণগ্রাহীদের বাছবিচার সম্পূর্ণ আলাদা হয়? এমনটাই ঘটেছিল বহুনন্দিত চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গখের 'দ্য পটেটো ইটার্স' চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে। শিল্পী এ ছবিকে নিজের অন্যতম পছন্দের চিত্রকর্ম মনে করলেও অন্যদের মতামত এমনটা ছিল না। ঠিক যেমন পরবর্তী সময়ে মাস্টারপিসখ্যাত 'স্টারি নাইট' ছিল তাঁর কাছে একটি ব্যর্থ কাজ। এ থেকে অন্তত ভ্যান গখের দর্শনটা আঁচ করা যায়- শিল্পীর নিজেকে শিল্পের সাথে সংযুক্ত করাটাই তার কাছে অধিক সাফল্যের, খ্যাতির নয়।
কেন এঁকেছিলেন এই ছবি?
১৮৮৫ সালের এপ্রিল এবং মে মাস জুড়ে ভ্যান গখ 'দ্য পটেটো ইটার্স' নামের এই বহুল সমালোচিত, বিশেষত নিন্দিত চিত্রকর্মটি আঁকা শেষ করেন। এই ছবিটিতে দেখা যায়, এক কৃষক পরিবার বসে রাতের খাবার খাচ্ছে। তাঁর মতে, এটি তাঁর প্রথম সফল কোনো কাজ। এই ছবিটি যেন তাঁর সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অনেকটা প্রতিফলন ঘটায়। শুধু 'ছবির মতো সুন্দর' ছবি এঁকেই নয়, তিনি তুলে আনতে চেয়েছিলেন মাটির মানুষদের গল্পগাথা। যাদের সাথে আপামর দরিদ্র জনসাধারণ নিজেকে যুক্ত করতে পারবে। তিনি তাদের ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন, যাদের সাথে জড়িয়ে থাকবে খেতবাড়ির ঘ্রাণ, নতুন ফসলের আনন্দ, হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে খাবার টেবিলে ভাগ করে নেয়া তৃপ্তির স্বাদ। যে সাধারণ খাবারে মাখা থাকবে জীবনের সবটা প্রাপ্তি, ঘরের একটামাত্র বাতিতে আলোকময় হবে নিজের প্রতিকৃতি- সেই চিত্রের খোঁজেই হয়তো শিল্পী সৌন্দর্যকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছিলেন। এসবের মধ্যে জমে থাকা পবিত্রতাকে শিল্পী খুঁজেছেন, যা হয়তো বিত্তশালীর ডাইনিং টেবিলে পাওয়া দুষ্কর হয়। আসলে ভাগ করে নেয়া দুঃখ কিংবা দারিদ্র্য ভাগ করে নেয়া তৃপ্তিরই নামান্তর।
অন্য শিল্পীদের মতো কৃষকদের জীবনকে দূর থেকে শান্তির বা আদর্শ জীবন হিসেবে দেখতে বা দেখাতে চাননি ভ্যান গখ। তিনি চেয়েছেন, এই ছবিতে ফুটে উঠুক সেই কৃষকদের জীবনের সত্য। রাতে নিজেদের মাঝে ভাগ করে নেয়া খাবারটুকু যে তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জন করেছে, তাদের সেই সৎ উপার্জনের চিত্রটুকুই তিনি ধরে রাখতে চেয়েছেন তার ক্যানভাসে। এবং তার সেই চেষ্টা অন্তত নিজের কাছে সফল হয়েছিল, নইলে এ ছবিকে সবচাইতে সফল কাজের তকমা দিতেন না।
শুধু ইতিবাচকতার কথাই বলে না এ ছবি, আর তাতেই বোধ হয় এত বিরুদ্ধমত জেগেছিল এ ছবির প্রতি। অপেক্ষাকৃত ডার্ক শেডের রঙ- নীল, সবুজ, বাদামি যেন বাইরের রুক্ষ প্রকৃতির জানান দেয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের একাকিত্ব যেন তাদের অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠে, জীবনের কঠোর বাস্তবতায় তাদের প্রত্যেককেই দারুণ ক্লান্ত মনে হয়। খুব একটা যোগাযোগ দেখানো হয়নি চরিত্রদের মধ্যে। তারা নিজেদের খেয়ালে মগ্ন, যেন এই টেবিলটা ঘিরে বসে থাকলেও তারা ঠিক এখানে নেই। সবাই যেন নিজের নিজের ভাবনা নিয়ে আছে, চোখেমুখে আশা কিংবা হতাশা।
তবু সবকিছুর মাঝে তারা নিজেদের চাষ করা আলুর মতোই একে অন্যেরও যতœ নেয়, নিজেদের একান্ত ভাবনায় মশগুল হয়েও কেউ একজন কফির কাপটা এগিয়ে দেয়, খালি পাতে তুলে দেয় মেপে রাখা খাবারটুকু, কেটে যাওয়া দিনের আলাপে প্রস্তুতি নেয় পরবর্তী সকালের
ডি গ্রুট পরিবার
যে খামারবাড়ির টেবিলে বসে চিত্রকর্মের সাবজেক্টরা খাওয়াদাওয়া করছিলেন, তা মূলত ডি গ্রুট পরিবারের। নেদারল্যান্ডসে বসবাসকারী, ভ্যান গখের পরিচিত ও সমসাময়িক এই পরিবারটি অসংখ্যবার মডেলরূপে তাঁর বহু চিত্রকর্মে কৃষকের প্রতিকৃতি আঁকতে সাহায্য করেছেন। এই ছবিটি দেখেও মনে হয়, খুব সহজেই যেন ছবিতে প্রবেশ করে একটা বাড়তি চেয়ার টেনে বসে পড়া যাবে তাদের সাথে খাওয়াদাওয়া করতে।
তাহলে নিন্দা কেন?
এই শিল্পকর্মকে নিজের প্যারিসীয় শিল্প বাজারে প্রবেশের টিকিট ভেবেছিলেন ভ্যান গখ। কিন্তু এত উচ্চাশার বদলে আশেপাশের লোকদের কাছ থেকে বেশ কড়া ভাষায় সমালোচনা হজম করতে হয়েছিল তাকে। বন্ধু ও আরেক শিল্পী অ্যান্থন ভ্যান র্যাপার্ড এ ছবির সমালোচনা করে ভ্যান গখকে চিঠি লিখেছিলেন, তার অংশ বিশেষ ছিল এরকম-
ছবির ঐ পাত্রটি ওখানে কী করছে, ওটা দাঁড়িয়েও নেই, কেউ ধরেও নেই, তাহলে কী? এবং ডানদিকের লোকটার কি কোনো হাঁটু বা পেট বা ফুসফুস কিছুই নেই? নাকি ওগুলো ওর পেছন দিকটায়? আর ওর হাতটাইবা কেন এক মিটার খাটো? তার আধটা নাকও নেই নাই?
চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৮৮৫ সালের ২৪শে মে তারিখে, অর্থাৎ ছবিটি আঁকা শেষ করার খুব কম দিনের ব্যবধানেই। কাঙ্খিত সাফল্যের পরিবর্তে ছবিটির এরকম প্রতিক্রিয়া মেনে নেওয়া খুব সহজ ছিল না গখের জন্য।
ভুল নাকি মাস্টারপিস?
'দ্য পটেটো ইটার্স: মিসটেক অর মাস্টারপিস?' নামে একটি প্রদর্শনী ভ্যান গখের এই 'সহজ কিন্তু জটিল' ছবিটির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ একবার আয়োজন করা হয়েছিল শিল্পীর মৃত্যুর অনেক বছর পর। লেখার প্রথমেই শিল্পী ও অন্যদের যে বিরোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, পরে সেই দ্বন্দ্বকে ভিত্তি করেই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। এতে মোট ৪৩টি চিত্রকর্ম, একটি স্কেচবুক, তিনটি প্রিন্টেড ছবি, তিনটি চিঠি এবং দুটো বই রয়েছে- যা ছবিটির সম্পূর্ণ গল্প তুলে ধরেছে। এমনকি এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে দর্শকরা বিশদ জানতে পারে, বাবা-মায়ের সাথে নেদারল্যান্ডসের ন্যুনেস নামক মফস্বল শহরে থাকাকালে ভ্যান গখ কীভাবে ধীরে ধীরে কৃষকদের শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। পুরো একটা শীতকাল তিনি কাটিয়ে দিয়েছিলেন কৃষকদের প্রতিকৃতি এঁকে। সেইসব ছবিরই শেষ গন্তব্য হয়ে ওঠে 'দ্য পটেট ইটার্স'। শিল্পীর ব্যক্তিগত চিন্তায়, ছবি আঁকার খাতায় সমান্তরালভাবে সেই জীবনের ছাপ পড়েছিল, যা পরবর্তী সময়েও কোথাও না কোথাও বজায় থাকে।
ছবিটি এখন কোথায়?
শিল্পীর মৃত্যুর পর, অর্থাৎ ১৮৯০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভ্যান গখের পরিবারের কাছে ছিল 'দ্য পটেটো ইটার্স' চিত্রকর্মটি। এর পর এটি ভিনসেন্ট ভ্যান গখ ফাউন্ডেশনের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। বর্তমানে এটি রয়েছে আমস্টারডামে অবস্থিত ভ্যান গখ জাদুঘরে। মূল তৈলচিত্রটি আছে নেদারল্যান্ডসের ওটার্লোতে অবস্থিত ক্রোলার-ম্যুলার জাদুঘরে। ভ্যান গখ এই ছবিটির লিথোগ্রাফও তৈরি করেছিলেন, যা কিনা নিউ ইয়র্ক শহরের মডার্ন আর্ট জাদুঘরে রয়েছে।