অনলাইন আবেদনে ঘরে বসে সেবা পাচ্ছেন নেত্রকোনার নারীরা
নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার বিশাড়া গ্রামের এক নির্যাতিতা নারী আসমা আক্তার। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় স্বামী একদিন তাকে অমানুষিক নির্যাতন ও শারীরিকভাবে আঘাত করে। পাঁচদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে স্থানীয় থানায় অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু থানা পুলিশ তার অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করছিল না। পরে আসমা আক্তার নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন পরিচালিত 'বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব উইমেন্স কর্নার' এর ওয়েবপেজে অনলাইনে আবেদন করেন। আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে এটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জেলা প্রশাসকের কাছে চলে যায়। এরপর জেলা প্রশাসক তা দেখে অনলাইন পদ্ধতিতেই অভিযোগটির ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। পুলিশ সুপার তা আবার কলমাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ফরোয়ার্ড করেন। তার নির্দেশে ওসি অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করে এফআইআর-এর কপিটি আবার ওয়েবপেজে আপলোড করেন। এদিকে বাড়িতে বসেই মুঠোফোনের খুদেবার্তায় সব জানতে পারেন আসমা। মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই সব তথ্য জানতে পারবেন তিনি।
নারী নির্যাতন, মানবাধিকার লংঘন, বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, নারী উদ্যোগ, আত্ম-কর্মসংস্থান, ঋণ সহায়তা, আর্থিক সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, ভূমি সংক্রান্ত সেবাসহ নারীদের বাড়িতে বসে, বিনা খরচে এবং খুব সহজ প্রক্রিয়ায় সেবাপ্রাপ্তির পথ নিশ্চিত করতে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এই কর্নারটি চালু করেছে। আর এটির সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে 'ডিজিটাল নেত্রকোনা ডট ওআরজি' (www.digitalnetrokona.org) নামের একটি ওয়েবপেজের মাধ্যমে। গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মসহ এই উইমেন্স কর্নারটি চালু করা হয়। ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে জেলা প্রশাসনের এই নিজস্ব এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগটি। পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, বিসিক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, ভূমি প্রশাসনসহ জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরগুলো যুক্ত রয়েছে এ ওয়েবপেজটির সঙ্গে। প্রতিটি দপ্তরের কর্মকর্তারা অনলাইন পদ্ধতিতেই নিশ্চিত করছেন আবেদনকারীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা।
জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আবদুর রহমান বলেন, "দূরদূরান্তের অনেক নারী আমাদের কাছে নানা ধরনের সেবা নিতে আসেন। কাউকে কাউকে একাধিকবারও আসতে হয়। তাদের দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। আবার সেবা দিতে ও নিতে গিয়ে উভয়পক্ষের পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে সেবার জন্য আসতে-যেতে ভুক্তভোগী নারীদের টাকা-পয়সাও খরচ করতে হয়। দেখা যায়, অনেক সময় তারা এসে কাঙ্ক্ষিত জনকে পানও না। তাই নারীদের সেবাপ্রাপ্তির পথটিকে আরও সহজ করতেই আমরা তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এ উদ্যোগটি চালু করেছি। জেলা পর্যায়ে এমন উদ্যোগ এটিই প্রথম।"
উইমেন্স কর্নার পরিচালনার যাবতীয় ব্যয় জেলা প্রশাসন থেকেই বহন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের ২০৪ নং কক্ষে এ উইমেন্স কর্নারটি অবস্থিত। একজন সহকারী কমিশনারের (ম্যাজিস্ট্রেট) নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের তিনজন কর্মচারী এটির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তারা ওয়েবপেজটি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখেন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ করেন। এছাড়া আবেদনকারী নারীর কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব উইমেন্স কর্নার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার নাজনীন আক্তার জানান, "বিভিন্ন ধরনের সেবার জন্য গত আট মাসে আমাদের ওয়েবপেজের মাধ্যমে মোট ১ হাজার ৩২৭টি আবেদন এসেছে। ১০ উপজেলার মোট ১ হাজার ২৩৪ জন নারী এসব আবেদন করেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন এসেছে আর্থিক সহায়তার জন্য। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে ৪৪৮ জন নারী জেলা প্রশাসনের কাছে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেছেন। নারী নির্যাতন, মানবাধিকার লংঘনসহ বিভিন্ন ধরনের আইনী প্রতিকারের আবেদন করেছেন ১১৬ জন। হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের আবেদন করেছেন ২১৩ জন। ক্ষুদ্র উদ্যোগের (কর্মসংস্থান) জন্য ঋণ সহায়তা চেয়েছেন ৬৭ জন। অন্যান্য ক্যাটাগরিতে (ভূমি সংক্রান্ত সেবা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিবন্ধী সেবা প্রভৃতি) আবেদন করেছেন আরও ৪৫৯ জন নারী।"
নাজনীন আক্তার আরও জানান, ১ হাজার ৩২৭টি আবেদনের মধ্যে ৯২৬ জন আবেদনকারীকে ইতিমধ্যে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া হয়েছে। বাকিদের আবেদনগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আবদুর রহমান জানান, আবেদনকারী নারী ইন্টারনেটযুক্ত মুঠোফোনের সাহায্যে জেলা বা জেলার বাইরের যে কোন জায়গা থেকে অথবা উইমেন্স কর্নারে সরাসরি এসে তার কাঙ্ক্ষিত সেবার জন্য আবেদন করতে পারেন। আবেদনের সঙ্গে তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও (ডক্যুমেন্টস) যুক্ত করতে পারেন খুব সহজে। এক্ষেত্রে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের নিয়োগপ্রাপ্ত উদ্যোক্তা এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরাও তাদের সহায়তা দিচ্ছেন।
"আবেদন পাওয়ার পর আমরা সেটি নিয়ে পর্যালোচনা করি। তিনি যদি আইনী প্রতিকারের আবেদন করেন- তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসহ সেটি পুলিশ প্রশাসনকে ফরোয়ার্ড করি। আবার যদি ভূমিসংক্রান্ত সেবার জন্য আবেদন করেন-তাহলে সেটি স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে ফরোয়ার্ড করে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিই। কেউ যদি আবার আর্থিক বা প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সেবার আবেদন করেন- তাহলে তাদেরকে আর্থিক বা প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিই। সেবা প্রদানকারী দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে তা আমলে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবাদান নিশ্চিত করছে এবং ওয়েবপেজে আবেদন-পরবর্তী হালনাগাদ তথ্য আপলোড করছে। এর ফলে আবেদনকারী নারী নিজ বাড়িতে বসেই মুঠোফোনের খুদেবার্তার মাধ্যমে তার আবেদন-পরবর্তী অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে পারছেন। এছাড়া উইমেন্স কর্নারের একটি হটলাইন নাম্বারও (০১৭৭১১৬৭৩০৬) রয়েছে। এই নাম্বারেও যোগাযোগ করে সাহায্য নিতে পারেন যে কেউ।"
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব উইমেন্স কর্নারের সহযোগিতায় সেবা পেয়েছেন এমন একজন তাকলিমা নাসরিন ঝুমুর। জেলা শহরের নাগড়া এলাকার বাসিন্দা তিনি। বাসার কাছে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে নারীদের জামাকাপড় বিক্রির পাশাপাশি সেলাই কাজ করেন। করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন কোন কাজ না পাওয়ায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে পড়ে। সংসার চালাতে গিয়ে পুঁজি নষ্ট করে ফেলেন। আটকে যায় তার কয়েক মাসের ঘরভাড়া। এমন অবস্থায় ঋণ সহায়তার জন্য ঘোরাঘুরি করছিলেন এখানে-সেখানে। তখন এক আত্মীয়ের পরামর্শে তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব উইমেন্স কর্নারের ওয়েবপেজে ঋণ সহায়তার আবেদন করেন। দু-তিনদিন পর মুঠোফোনে জানতে পান, তার আবেদনটি গ্রহণ করা হয়েছে। এর কয়েকদিন পর বিসিক থেকে তাকে স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের জন্য ডাকা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে এক লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দেয়া হয় তাকে। ঋণ পেয়ে আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
ঝুমুর বলেন, "ঋণ সহায়তা পেতে আমার একটি টাকাও খরচ করতে হয়নি। এমনকি কোন রকম ঝামেলাও পোহাতে হয়নি।' সদর উপজেলার কান্দুলিয়া গ্রামের তাসমিন আক্তার তাসলিমাও একই প্রক্রিয়ায় আবেদন করে দেড় লাখ টাকা ঋণসহ প্রশিক্ষণ পেয়ে এখন ব্লক-বুটিকের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাসলিমা বলেন, 'করোনাকালে একটি প্রতিষ্ঠান আমিসহ পাঁচ নারীকর্মীকে ছাঁটাই করে দেয়। এতে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন পরিচালিত ওয়েবপেজে আবেদন করে খুব সহজে ঋণ পেয়ে যাই।"
সদর উপজেলার মৌজেবালী গ্রামের মোছা. সাহেরা খাতুন বলেন, "আমি জমি খারিজ করার পর সরকারি ফিস জমা দিতে গিয়ে বেশ ভোগান্তির শিকার হয়েছিলাম। পরবর্তীতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব উইমেন্স কর্নারের ওয়েবপেজে আবেদন করে দু'দিনের মধ্যেই প্রতিকার পাই। ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা আমাকে ডেকে নিয়ে ফিস গ্রহণ এবং তাৎক্ষণিক জমা রশিদের ডুপ্লিকেট কার্বন কপি (ডিআর) প্রদান করে।"
জানা গেছে, এই অনলাইন সেবাটির কথা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচার করতে এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নানা শ্রেণি-পেশার নারীদের ওরিয়েন্টেশন প্রদানসহ লিফলেট বিতরণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম কর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাও সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে। যার ফলে খুব সাড়া ফেলেছে উদ্যোগটি।
স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক বেগম রোকেয়া বলেন, "শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের বৈষম্যহীন উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে এই ডিজিটাল প্লাটফর্মটি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এর ফলে সেবাগ্রহীতা নারীদের ভোগান্তি কমছে। কাজেই নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগটিকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করে তা সারা দেশেই চালু করা যেতে পারে।"