ভূমিধসে বন্ধুকে হারিয়েছেন, এখন বন উজাড়ের বিরুদ্ধে নারকেল দিয়ে লড়ছেন তিনি
পৃথিবীতে কিশোরটির আপন ছিল শুধু দারিদ্র্য। আলহাজি সিরাজ বাহ রাতে ঘুমাতো সেতুর নিচে। অসহায় এই কিশোরকে দয়াপরবেশ হয়ে পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে স্থানীয় একটি পরিবার। পালক পিতামাতার সন্তান আব্দুল হয়ে ওঠে তার সেরা বন্ধু।
কিন্তু, এই সুখ সয়নি সিয়েরা লিয়নবাসী বাহের কপালে। এক রাতের আকস্মিক ভূমিধসে হারান পালক পরিবারের সকলকে।
সিয়েরা লিয়নের সুগারলোফ পাহাড়ের ধাপে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকায় ছিল তার পালক পিতামাতার বাড়ি। তিনদিনের টানা বৃষ্টির পর স্থানীয়রা ঘটনার আগে বজ্রপাতের মতো প্রচণ্ড শব্দ শুনেছিলেন। সঙ্গেসঙ্গেই ধসে যায় মাটি। সব বাড়িঘর আর জীবিত বাসিন্দাদের নিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে যায় কাদার বন্যা। কেউই সেদিন বাঁচতে পারেনি।
আব্দুলের সাথেই একঘরে থাকতেন বাহ। বেচে থাকার কথা তারও নয়। তবে সেদিন বাড়িতে থাকা হয়নি তার। বাহ যে পানিশোধন কারখানায় কাজ করতো; সেটির মালিক তাকে নৈশকালীন শিফটে কাজে রেখেছিলেন।
২০১৭ সালের ওই ভয়াল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ও নিখোঁজ হন ১ হাজার ১৪১ জন। কারখানা থেকে ফিরে অনেক খুঁজেও পরিবারের কাউকেই পায়নি বাহ। এই স্মৃতি তার মনোজগতে স্থায়ী আঁচড় কাটে।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে ২২ বছরের এ তরুণ বলেন, 'শুধু অসহায় বোধ করছিলাম। পৃথিবীতে যেন আবার একা হয়ে গেলাম। তাই আমি এ সমস্যা সমাধানের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করি।'
চার বছর পর বাহ আজ এমন এক ব্যবসা পরিচালনা করছেন; যা প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় রেখে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তার প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করেন তিন ডজনের বেশি কর্মী। লক্ষ্যও বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী - সিয়েরা লিয়নে বৃক্ষ নিধনের অবসান।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্থানীয় দরিদ্র জনগণ জ্বালানি কাঠের জন্য গাছ কেটে ফেলায়, মারাত্মক হারে বেড়েছে ভূমিক্ষয়। একারণেই বৃষ্টিপাতের সময় কাদাস্রোতের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে।
বাহের প্রতিষ্ঠানটি এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের কাঠের পরিবর্তে নারকেলের তৈরি চারকোল বা মণ্ড জাতীয় জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহিত করছে।
এই আইডিয়াটি এসেছে স্থানীয় সম্পদ কাজে লাগানোর যুগপৎ চিন্তা থেকেই। বাহ লক্ষ্য করেন, রাজধানী ফ্রিটাউনের ডাব ও নারকেল পানি বিক্রেতারা প্রতিদিন হাজার হাজার আঁশ ফেলে দিচ্ছেন, যা হতে পারে বিকল্প জ্বালানির এক অনন্য উৎস। এসব সংগ্রহ করেই তার ব্যবসার শুরু।
রুগসাল ট্রেডিং নামক তার কোম্পানি এখন দিনে ১০০ টন নারিকেলের চারকোল বা শুকনো মণ্ড তৈরি করছে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের জ্বালানি দীর্ঘক্ষণ ধরে জ্বলে। সিয়েরালিয়নের অধিকাংশ মানুষই বাড়ির বাইরে ছোট চুলায় রান্না করে। তাদের জন্য এ জ্বালানি খুবই সাশ্রয়ী ও উপযোগী। কাঠের চেয়ে অনেক কম পরিমাণ নারিকেলের চারকোল দেয় সহজে রান্নার সুবিধা।
এর আগে ফিলিপাইনে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, রান্নার কাজে এক টন নারকেলের চারকোল ব্যবহার করলে ১০ সেন্টিমিটার ব্যাসের ৮৮টি গাছের জীবন বাঁচানো যায়।
মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন টাইমসকে বাহ বলেন, 'আমার প্রেরণা হলো: প্রতিষ্ঠান যত বড় হবে, ততো বেশি গাছ রক্ষা করতে পারব। বিকল্প অথচ সেরা উপায় সম্পর্কে পৃথিবীকে সচেতন করাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ, মানুষ কাঠের তৈরি চারকোল ব্যবহারেই অভ্যস্ত।'
পশ্চিম আফ্রিকার দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল ওই ভূমিধস। এ ঘটনার সঠিক কারণ নিয়ে এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন গবেষকরা। তবে অনেকেই সুগারলোফ পাহাড়ে ক্রমে সবুজ আচ্ছাদন হারিয়ে যাওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বন উজাড়ের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ বাড়ে, দুর্বল হয় পাহাড়ি ঢাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য গাছের ভূমিকা অপরিসীম। সবুজ পাতার ছাউনি মাটিতে সরাসরি বৃষ্টির পানি পড়তে দেয় না। শেকড়ের মজবুত বাঁধন মাটির ক্ষয় কমায়। বন্যার প্রকোপ কমাতেও সাহায্য করে বৃক্ষের আচ্ছাদন।
কিন্তু, আসবাব, বাড়ি নির্মাণ এবং জ্বালানির জন্য ফ্রিটাউনের মানুষ কেটে সাফ করে ফেলছে আশেপাশের পাহাড়ের সবুজ ছাউনি। কাঠ থেকে তৈরি চারকোল ও লাকড়িই দেশটিতে রান্নার প্রধান জ্বালানি।
বন উজাড়ের আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা- গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্যমতে, গত দুই দশকেই ৩০ শতাংশের বেশি বন আচ্ছাদন হারিয়েছে সিয়েরা লিয়ন।
বাহ লক্ষ্য করেন, প্রতিদিন আশেপাশের এলাকার মানুষ বন কেটে কাঠ সংগ্রহ করছে। কেউ কেউ কাঠ পুড়িয়ে চারকোল বানিয়ে বিক্রি করছে। তার পরিচিত সবাই সেই কাঠকয়লা দিয়েই সারছেন রান্নাবান্নার কাজ।
এই দশা পরিবর্তনের উপায় নিয়ে তখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন বাহ।
বাহের সংগ্রাম ও সমাধান আবিষ্কার:
ছোট থেকেই বিশ্বের বড় বড় উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে জানতে উৎসাহী ছিলেন বাহ। ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী ও সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ তার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। বাহের জন্মদাতা পিতা ছিলেন একজন গাড়িচালক। বাহ যখন মাত্র ১২ বছরের তখনই মারা যান তিনি। তার মা দুই ছেলেমেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে পারতেন না। তাই একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে রাজধানী ফ্রিটাউনে চলে আসেন বাহ। এখানেই খুঁজছিলেন একটা কিছু করার উপায়।
বাহ বলেন, 'ভেবেছিলাম এখানে এসে উপার্জনের সুযোগ পাব, তখন মা আর বোনকে সাহায্য করতে পারব।'
এরপর চার বছর কাটিয়েছেন পথে পথে। খাবার জোগাড় করতে গাড়ি ধোয়ামোছার কাজ করতেন। এমন অবস্থাতেই একদিন ফুটবল খেলার মাঠে তার পরিচয় হয় আব্দুলের সাথে। প্রথম সাক্ষাতেই গড়ে ওঠে প্রাণের বন্ধুত্ব। ভূমিধসের ওই ঘটনার আগের চার বছর আব্দুলের পরিবারের সাথেই থেকেছেন বাহ।
বাহের এককালের ছিন্নমূল জীবনের সঙ্গী ফদে কনটে বলেন, 'ভূমিধসের ওই ঘটনার পর সে আমূল বদলে যায়। বেশিরভাগ সময় সে ইউটিউবে পরিবেশ সচেতন ভিডিও দেখতে ব্যয় করতো। বন বাঁচাতে সে প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল।'
বাহের বয়স তখন ১৭। একদিন ইউটিউবে দেখলেন এক ইন্দোনেশীয়র ভিডিও। ওই ব্যক্তি নারিকেলের আঁশ থেকে চারকোল তৈরির উপায় দেখিয়েছিলেন। বাহ আরও জানলেন, আফ্রিকার অন্য দুটি দেশ ঘানা ও কেনিয়াতেও পরিত্যাক্ত নারকেলের আঁশ সংগ্রহ করে তা রোঁদে শুকিয়ে, গুড়ো করে এবং ইস্পাতের ড্রামে জ্বালিয়ে চারকোল তৈরি হচ্ছে।
তিনি আরও দেখলেন, উৎপাদকরা কাসাভা নামক এক ধরনের শেকড় থেকে তৈরি আটা পোড়ানো নারকেল গুড়ায় মেশান। এরপর মণ্ডগুলো মেশিনে খণ্ডখণ্ড করে ও শুকিয়ে চারকোলের চেনা আকার দেওয়া হচ্ছে।
অর্থাৎ, কাঠের মতো করেই বানানো যাবে নারকোল খোসার চারকোল।
বাহ বলেন, 'সবকিছু দেখেশুনে একে ব্যবসার সেরা উপায় মনে হলো। ভেবে দেখলাম, সারাদিন পথে পথে ঘুরে এসব খোসা বিনামূল্যেই কুড়াতে পারব। তা দিয়ে আবার জ্বালানিও বানানো যাবে।'
যে পানি শোধনাগারে কাজ করতেন, তার মালিকের কম্পিউটার ব্যবহার করেই এই ব্যবসার নানান দিক নিয়ে গবেষণা করতে লাগলেন। এক সময় জানলেন, চারকোল তৈরির মেশিনের দাম প্রায় ৩ হাজার ডলার।
মালিকের কাছে বেতন বাড়ানোর অনুরোধ করলেন। কিন্তু সামান্য বেতনে এত বড় পুঁজি সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। সামান্য কিছু টাকা বাঁচিয়ে তা দিয়ে কিনলেন আঠা ও কাঁচি। উদ্দেশ্য ফেলে দেওয়া কাগজ থেকে ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করে চারকোল মেশিন কিনবেন।
ফ্রিটাউনের এক সহ্রদয় হোটেল মালিক উদ্যমী এ কিশোরের ব্যাগ কিনতে রাজিও হলেন। তার জন্য হাজার খানেক ব্যাগ বানিয়ে ১০০ ডলার আয় করলেন বাহ। ধীরে ধীরে ব্যাগের গ্রাহক আরও বাড়ল। সেই টাকা জমিয়ে একসময় মণ্ড তৈরির যন্ত্রটিও কিনে ফেললেন অদম্য বাহ।
এভাবেই তার ব্যবসার পথচলা শুরু। আজ তার পণ্য স্থানীয়দের প্রশংসা কুড়াচ্ছে। মুনাফালোভী বড় কর্পোরেশনের পরিবেশ বিনাশী অর্থনীতির যুগে তরুণ এ উদ্যোক্তা একইসঙ্গে ব্যবসা ও পরিবেশ সংরক্ষণের অনন্য উদাহরণই সৃষ্টি করে চলেছেন।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট