এই নোঙর কার? যা দেখতে ভিড় করেছিল শত শত লোক!
সেসময় হাতে গড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নোঙর টাইটানিকের। দৈর্ঘ্যে সাড়ে ১৮ ফুট। প্রস্থে মাথার দিকটা ছিল ১০ ফুট ৯ ইঞ্চি। আর এর ওজন ছিল ১৬ টন। যুক্তরাজ্যের নেথারটনের নোয়াহ হিংলে অ্যান্ড সন্স লিমিটেড নোঙরটি তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিল। নেথারটন সেসময় শেকল ও নোঙর তৈরিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। তবে হিংলে একা পুরো নোঙর গড়ে তোলেনি। তারা এরসঙ্গে আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে।
ঢালাই দিয়ে নোঙরের মাথা তৈরি করে নিউক্যাসেলের জন রজারসন অ্যান্ড কোম্পানি। আবার নোঙরের শ্যাঙ্ক বা দীঘল অংশের কাজ পেয়েছিল সমারস নামের প্রতিষ্ঠান। নোয়াহ নিজে তৈরি করেছিল নোঙরের আংটা, আংটার পিন, শ্যাঙ্ক সংযুক্তি খিল, মাথা যোগকারী কিলক, শিকল ও ডেক স্টপার। ভিক্টোরীয় যুগের শেষ এবং এডওয়ার্ডীয় যুগের শুরুতে প্রচলিত ঢালাই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল। ঢালাইয়ের এই কাজ সহজ ছিল না। শ্যাঙ্ক তৈরির কাজটির কথাই ধরা যাক। ছোট ছোট অসংখ্য লোহার বার ৫০০০ ডিগ্রি তাপে গলিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ঠাণ্ডা হয়ে আসার প ২০ টন ওজনের একটি বাষ্পচালিত হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটানো হয়। হাতুড়ি পেটানোর কাজে যারা সাহায্যকারীদের নাম হয় হ্যামারম্যান।
কার্যকারিতা পরীক্ষা
হিংলে ওয়ার্কসে প্রাথমিক জোড়া শেষে চলে কার্যকারিতার পরীক্ষা। প্রথমে ড্রপ (নোঙর ফেলা) করার পরীক্ষা, তারপর আকড়ানোর পরীক্ষা ইত্যাদি। তারপর লায়ডের পরামর্শমতো সবগুলো যন্ত্রাংশ আরো একটু চাচাছোলার কাজ করা হয়। তারও পরে আরো ঠুকে ঠুকে সবগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি আটানো হয়। তবে বিশেষ মজার ঘটনা ছিল শব্দ পরীক্ষা। নোঙরটিকে টেনে ওপরে উঠানোর পর একটি হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দেওয়া হয়। পরীক্ষকরা অপেক্ষায় ছিলেন ঢংঢং করে শব্দ হবে। তাহলেই ভালোমতো বোঝা যাবে। অবশেষে প্রুভিং হাউজ লায়ড হ্যাঁ সূচক বার্তা পাঠালো। তারপর তারিখ ও সুপারিন্টেন্ডের স্বাক্ষর দিয়ে গায়ে স্ট্যাম্প দেওয়া হলো। ওজন, ড্রপ টেস্ট আর ব্যবহৃত উপকরণের বিবরণ পরিস্কার করে লেখা হলো। শ্যাংক ও মাথা ম্যাট হোয়াইটে রাঙানোর পর অ্যাংকরটি ডকইয়ার্ডে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত।
নোঙড়ের শেকল
টাইটানিকের শেকলের প্রতিটি আংটা ছিল দশাসই আর তৈরি হয়েছিল গলানো লোহা দিয়ে। হিংলের সেরা কাজ বলা হয় একে। এর সবচেয়ে বড় আংটাটি ছিল ৩ ফুট। পুরো শিকলটির মোট দৈর্ঘ্য ছিল ১২০০ ফুট।
নোঙর টানা
তিনটি বাহনে চড়েছিল নোঙরটি। প্রথমে ওয়ার্কশপে নিতে হয়েছে রেলস্টেশনে। তারপর রেল থেকে নেমে চড়েছিল জাহাজে, আর ওই যাত্রা ছিল রাজকীয়। ২০টি ঘোড়ায় টানা রথে চড়ানো হয়েছিল এটিকে। ১৯১১ সালের ৩০ এপ্রিল নেথারটন শহরের ট্রামগুলোকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শহরের লোকেরা জড়ো হয়েছিল ৩.২ কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারে। হিংলে ওয়ার্কস থেকে যাত্রা করে রথটি পেরিয়েছিল নেথারটন হাই স্ট্রিট, তারপর সিন্ডার ব্যাংক। এরপর ব্লোয়ারস গ্রিন পেরিয়ে গিয়েছিল ডুডলে টাউন সেন্টারে। ডুডল হাই স্ট্রিট ও বাজার পেরিয়ে তা পৌঁছেছিল ক্যাসল হিলে। রাস্তার নাম দেখেই বোঝা যায় পথ ছিল উঁচু নিচু, মাঝপথে গুটিকয় ঘোড়া হাঁপিয়েও উঠেছিল।
তাদের সহায়তা দিতে জরুরিভিত্তিতে পাঠানো হয়েছিল আরো ৬টি ঘোড়া। শেষপর্যন্ত ভালোয় ভালোয় ঘোড়াগুলো গিয়ে থেমেছিল ডুডলে রেলস্টেশনে। ততক্ষণে বিকাল। রাতের ট্রেনে কয়েকটি বেশি ইঞ্জিন লাগাতে হয়েছিল, ট্রেনটা তো সেদিন কিছু ভারীই হয়ে গিয়েছিল। ফ্লিটউড পৌঁছাতে তেমন কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি। তারপর এটিকে ওঠানো হয়েছিল কার্গো স্টিমার ডিউক অব আলবেনিতে। তারপর আইরিশ সাগর পার হতে হলো নোঙরটিকে। মে মাসের পাঁচ তারিখে গিয়ে পৌছালো বেলফাস্টে। তারপর আবার ঘোড়ায় টানা রথ। আর শেষে গিয়ে পৌছাল হারল্যান্ড অ্যান্ড ওলফ শিপইয়ার্ডে। জোড়া লাগানোর পরীক্ষায় ভালোভাবেই উৎরে গেল অ্যাংকরটি। এর মধ্যে টাইটানিকেরও সমুদ্র পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফিরে এসেছে ডকইয়ার্ডে। এবার তার নোঙরটি জুড়ে দেওয়ার কাজ। শেকল, শক্ত দড়ি সব দিয়ে বেঁধে টাইটানিক নোঙরটিকে আপন করে নিল।
তোলা হয় ছবিও
আগে থেকেই নোঙর বানানোর ছবি তুলে রেখেছিলেন আলোকচিত্রী এডুইন বার্ক। শিকল, পিন, খিল, কীলক, হেড, বডি, ঘোড়ায় টানা, জাহাজে ওঠানো ইত্যাদি সব কিছুরই ছবি তুলেছিলেন তিনি।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিংলে
কার্ডলে নামের এক গ্রামে নোয়া শেকল দিয়েই শুরু করেছিলেন । ১৮৩৮ সালে নোয়া হিংলে (১৭৯৬-১৮৭৭) যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট মিডল্যান্ড কাউন্টির ব্ল্যাক কান্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা করেন হিংলে অ্যান্ড সন্স। ১৮৫২ সালে প্রতিষ্ঠানটি নেথারটনে স্থানান্তরিত হয়। সেখানকার ২নং ডুডলে খালের ধারে বড় বড় শেকল ও নোঙর বানানোর কারখানা গড়ে তোলেন হিংলে। তারা ধাতব দড়িও তৈরি করত। একসময় নোয়া গড়ে তোলেন ব্লাস্ট ফার্নেস (মূলত কাঁচা লোহা উৎপাদনক্ষেত্র, তামা আর সীসাও তৈরি হয়, কমপক্ষে ত্রিশ ফুট উঁচু হয়, কমপক্ষে ১৬০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকে এতে) এবং আয়রনওয়ার্ক্স। ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি শেন নদীর নৌকাগুলোর জন্য টোয়িং চেইন নির্মাণ করে (স্রোতের বিপরীতে চলার সময় নৌকাগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি বাঁধা হয় এ শেকল দিয়ে, সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী নৌকাটি সবার আগে থাকে)। একই বছর জার্মানিতেও ২০ মাইল লম্বা টোয়িং চেইন সরবরাহ করে হিংলে। পরের বছর বাষ্পীয় জাহাজ অ্যাড্রিয়াটিকের জন্য হিংলে অতিকায় ধাতব রজ্জু তৈরি করে। এটি ছিল ৪০ গজ দীর্ঘ, আর এর প্রতিটি আংটার ওজন ছিল ৫০ পাউন্ড।
তার পরপরই এসএস গ্রেট ইস্টার্নের জন্য আরো মজবুত রজ্জু বানানোর ফরমায়েশ পায় হিংলে। ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির ব্লাস্ট ফার্নেসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪টি। নোয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে বেনজামিন হিংলে (১৮৩০-১৯০৫) এটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তারপর পরিচালক হন বেনজামিনের ভাস্তে জর্জ বেনজামিন হিংলে। ১৮৮০ সালে এসে লেখক উইলিয়াম কার্জন জানাচ্ছেন, প্রতিষ্ঠানটি ৩৬ হাজার টন কাঁচা লোহা, ৬০ হাজার টন ফিনিশড বার এবং ১০ হাজার টন ওজনের নোঙর ও শেকল উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। ১৮৮৫ সালে এর কর্মীর সংখ্যা ছিল ৩০০০। ১৯০৬ সালে হিংলে ওশেন লাইনার লুসিতানিয়া এবং মৌরিতানিয়ার জন্য নোঙর ও শেকল বানায়। ১৯১০ সালে হোয়াইট স্টার লাইনার অলিম্পিকের নোঙর বানায় হিংলে। প্রায় সাড়ে ১৫ টন ওজনের ওই নোঙরটি ছিল তখন পর্যন্ত ইতিহাসের সবচেয়ে ভারী নোঙর। তার পরের বছরই টাইটানিকের নোঙর বানায় হিংলে। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি হিংলে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে আসে এবং সিরিল লায়ড প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হন (১৮৯০ সালেই এটি ইনকরপোরেটেড প্রতিষ্ঠান হয়ে লিমিটেড কোম্পানি হয়)। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে এফএইচ লায়ড অ্যান্ড কোম্পানি কিনে নেয়।
নোঙরের বাড়ি ফেরা
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ৯৮ বছর পর ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর ডুডলেতে ফেরত আনা হয়েছিল জাহাজটির নোঙর। তবে সেটি রেপ্লিকা বা অনুকৃতি। চ্যানেল ফোর হিস্ট্রি চ্যানেল অ্যাংকরটির ঘোড়ায় টানা দৃশ্য পুনরায় নির্মাণ (রিইনঅ্যাক্ট) করেছিল। তখনকার কাউন্সিলর ডেভিড স্ট্যানলি (পরিবেশ ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সদস্য) বলেছিলেন, ব্ল্যাক কান্ট্রি লিভিং মিউজিয়ামই নোঙরটি রাখার আদর্শ স্থান। নেথারটন জন্মভূমি হওয়ায় এটিই তার বাড়ি হওয়া ভালো।'
অবশেষে ২০১১ সালের শেষদিকে নেথারটনে জায়গা নেয় নোঙরটি।
- সূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া টাইটানিকা