ভেঙে ফেলা হচ্ছে দেশের প্রথম আর্ট স্কুল ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ ভবন
১১৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম আর্ট স্কুল খুলনার 'মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট' ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের শিল্পরুচিবোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্মারক শতাব্দী প্রাচীন ভবনটি মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় একজন ঠিকাদার কিনে নিয়েছেন।
এদিকে, দেশের প্রথম অঙ্কনশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট' ভবনটি সংরক্ষণের দাবিতে আগামী ১৫ জানুয়ারি খুলনা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র পিকচার প্যালেস মোড়ে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জনউদ্যোগ খুলনা। এছাড়া ইতিহাসখ্যাত 'মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আট' ভবনটি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
জানা যায়, ১৯০৪ সালে খুলনা মহানগরীর মহেশ্বরপাশার নিজ বাড়ির গোলপাতা ঘরে খুলনা আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন রায় বাহাদুর শশীভূষণ পাল। অভিভক্ত বাংলায় কলকাতা আর্ট স্কুলের পর এটিই দ্বিতীয় আর্ট স্কুল এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রথম আর্ট স্কুল। শিল্পী শশীভূষণ পাল এই আর্ট স্কুলের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করতেন তার স্ত্রী কামিনী সুন্দরী, জ্যেষ্ঠপুত্র সুধাংশু শেখর পাল ও সুরেন্দ্রনাথ পাল। পরবর্তীকালে মহেশ্বরপাশা আর্ট স্কুল 'মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট' নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮৩ সালে নগরীর বয়রায় স্থান্তারিত করে এই স্কুলটিকে আর্ট কলেজ হিসেবে উন্নীত করার পর নতুন নাম দেওয়া হয় 'শশীভূষণ আর্ট কলেজ'। পরে এই কলেজের নামকরণ করা হয় 'খুলনা আর্ট কলেজ'। ২০০৯ সালে খুলনা আর্ট কলেজটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। যার বর্তমান নাম 'চারুকলা স্কুল'।
খুলনা মহানগরীর মহেশ্বরপাশা গ্রাম অনেককাল আগে থেকে একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। ১৯২১ সালে তৈরি যশোর-খুলনার মানচিত্রে এ গ্রামের অবস্থান নির্দেশিত হয়েছে। শিল্পপ্রেমী শশীভূষণ পাল আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার পর মহেশ্বরপাশা গ্রামের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পর ১৯১৭ সাল থেকে স্কুলটিতে নিয়মিতভাবে 'বার্ষিক শিল্পকর্ম' প্রদর্শনী শুরু হয়। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ নির্বাচন করে ভারতের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে পাঠানো হতো। ১৯১৮ সাল থেকে তৎকালীন গভর্মেন্ট ও জেলা বোর্ড থেকে স্কুলের নামে সাহায্য আসতে থাকে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এ সাহায্য স্থায়ী ও নিয়মিত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালের দিকে মাসিকভিত্তিতে সরকারি এ সাহায্যের পরমাণ দাঁড়ায় ১৬০ ও জেলা বোর্ডের ৪০টাকা। ১৯২০ সালে বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদ মহারাজ বাহাদুর এ স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তিনি স্কুলটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯২২ সালের জুলাই মাসে এ স্কুল পরিদর্শনে আসেন তদানীন্তন বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন। এ স্কুল দেখে তিনি খুব খুশি হন। গভর্নর লর্ড লিটন পরে লর্ড রোনাল্ড সে' ও খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন স্কুলটি পরিদর্শন করার জন্য। নির্দেশ অনুযায়ী তারা বহুবার স্কুলটি পরিদর্শন করেন। ১৯২৮ সালে আর্ট স্কুলে নির্মিত হয় 'নতুন ভবন'। ১৯২৯ সালের ১৯ মে এই ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তদানীন্তন খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ. কুইনটন। খুলনা-যশোর মহাসকের পশ্চিম পাশে অযত্ন-অবহেলায় আজও যা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ তার গুরুত্ব হারায়। তারপরও স্কুলটিতে কোনোরকম কার্যক্রম চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাণী ভিক্টোরিয়ার আবক্ষমূর্তিসহ আর্ট স্কুলের ছোট-বড়ো অসংখ্য মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর স্কুলের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ শশীভূষণ শিক্ষা নিকেতনের শিক্ষক আলাউদ্দীন আহমদের হাতে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে ভারতে চলে যান। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্কুলটি আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ স্বাধীনের পর বিশেষ করে আশির দশকের শুরুতে এ স্কুলটির প্রতি পুনরায় সুধীজনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে থাকে। ১৯৮৩ সালে স্কুলটি নতুনভাবে চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তখন এর নতুন নাম দেওয়া হয় 'শশীভূষণ আর্ট কলেজ'। ১৯৭৪ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও কবি জসিমউদ্দীন এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশের প্রথম অংকন শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়েছিলেন। শিল্পী সুলতান নানা সময়ে এ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছেন।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট ভবনটি ঘিরে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। মহেশ্বরপাশা শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম বলেন, শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী পুরাতন ভবনটি অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটি। ইতোমধ্যে গত ৫ জানুয়ারি একজন ঠিকাদার ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় দরপত্রের মাধ্যমে নিলাম পেয়েছে। তবে, এখনো ভবন অপসারণের কোনো চিঠি আমরা হাতে পাইনি। আমরা চাই ইতিহাসসমৃদ্ধ এই ভবনটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষণ করা হোক।
এদিকে, ইতিহাসসমৃদ্ধ এই ভবনটি অপসারণের উদ্যোগ নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে খুলনাসহ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা। ইতোমধ্যে দেশের প্রথম অঙ্কনশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট' ভবনটি সংরক্ষণের দাবিতে আগামী ১৫ জানুয়ারি খুলনা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র পিকচার প্যালেস মোড়ে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জনউদ্যোগ। এছাড়া ইতিহাসখ্যাত 'মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট' ভবনটি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
বিবৃতিতে তারা বলেন, পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের শিল্পরুচি-বোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্মারক ১৯০৪ সালে শিল্পী শশীভূষণ পাল কর্তৃক স্থাপিত দেশের প্রথম অংকন শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট। নিজ বাড়িতে এই শিল্প বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন শশীভূষণ পাল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯২৯ সালে নিজ বাড়িতেই চিত্রশিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সুরম্য ভবন নির্মাণ করা হয়। এই ভবনটিতে দীর্ঘ সময় আর্ট স্কুলটির কার্যক্রম চলে। বর্তমানে ঐতিহ্যের স্মারক এ ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য দরপত্র আহ্বান করাহয়েছে। আমরা ফেসিলিটিজ অধিদপ্তরের এহেন দায়িত্ব জ্ঞানহীন ঐতিহ্য ও ইতিহাস ধ্বংসের কর্মকাণ্ডে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।
বিবৃতিদাতারা হলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, অনুপম সেন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, সারওয়ার আলী, আবেদ খান, সেলিনা হোসেন, লায়লা হাসান, আবদুস সেলিম, মফিদুল হক, শফি আহমেদ, শাহরিয়ার কবির, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুনতাসীর মামুন, সারা যাকের, শিমূল ইউসুফ ও গোলাম কুদ্দুছ।
এ ব্যাপারে খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, পুরাতন ভবনের একপাশ ভেঙ্গে ফেলে হয়েছে। মাঝখানে একটা হলের মতো আছে। ওটা যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। ওখানে কর্তৃপক্ষ চারতলা একটা ভবন করবে। তবে, এ ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আমি এর বেশি কিছু জানি না।