প্রাচীন এই সভ্যতা কেন ৭০০ বছর স্বর্ণের লোভ ভুলে গিয়েছিল?
চার হাজার বছর আগে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট সোনার জিনিসের মালিক ছিল কাস্পিয়ান ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর গোষ্ঠীগুলো। জীবিকার জন্য এসব গোষ্ঠী পশু চরাত। তবে তারা স্বর্ণও সংগ্রহ করত।
এই যাযাবরদের অভিজাতরা স্বর্ণের জিনিস নিয়ে রীতিমতো গর্ববোধ করত। অভিজাতদের সমাধিস্তম্ভে এরা সোনার পানপাত্র, গয়না ও অন্যান্য রত্ন দেওয়া হতো। স্বর্ণসমৃদ্ধ এই অঞ্চলের গল্প ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। এ অঞ্চল নিয়ে তৈরি হয় নানা লোককাহিনি। সোনায় মোড়ানো এ অঞ্চল আজ পরিচিত জর্জিয়া ও ককেশাস পর্বত নামে।
তবে নতুন প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ককেশাস অঞ্চলে প্রায় ৭০০ বছর সোনা মোটেই জনপ্রিয় ছিল না। সাড়ে চার হাজারের বেশি শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন, ১৫০০ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এ অঞ্চলে সোনার জিনিস দুর্লভ হয়ে পড়ে। গবেষকদের ধারণা, অঞ্চলটির বাসিন্দাদের কাছে সোনা দেখনদারির জিনিস ছিল।
গবেষক প্রত্নতত্ত্ববিদ নাথানিয়েল আর্ব-সাতুলোর ধারণা, সোনার কদর পড়ে যাওয়ার কারণ অভিজাতদের মর্যাদা কমে যাওয়া। সাধারণ মানুষরা সম্ভবত ধনীদের জীবনযাত্রার ধরন নিয়ে—যেমন অতিরিক্ত স্বর্ণের ব্যবহার—সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিল। ধনী ও ধনীদের সম্পদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সাধারণ জনগণ।
আর্ব-সাতুলো গত দশকের মাঝের দিকে জর্জিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় অবসর সময়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক জাদুঘরে ঢুঁ মারতেন। জাদুঘরগুলোর সোনার শিল্পকর্ম খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন তিনি। একসময় লক্ষ করেন, ওই জিনিসগুলোর নির্মাণকালের মধ্যে বড় ব্যবধান রয়েছে। প্রদর্শনীগুলোতে ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে, অর্থাৎ মধ্য-ব্রোঞ্জ যুগে তৈরি 'সুদৃশ্য প্রাচীন সোনার' জিনিস দেখানো হতো। ৮০০ থেকে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বের কিছু ধ্বংসাবশেষও দেখানো হতো ওসব প্রদর্শনীতে। ওই সময়ি গ্রিকরা এ অঞ্চলে আসতে শুরু করে। কিন্তু আর্ব-সাতুলো এই দুই সময়ের মাঝখানের—ব্রোঞ্জ যুগের শেষার্ধ ও লৌহ যুগের প্রথমার্ধ—সোনার শিল্পকর্ম দেখেননি বললেই চলে।
জর্জিয়ান সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে আর্ব-সাতুলো জানতে পারেন, সোনার শিল্পকর্মের সময়ের এই ব্যবধানটা তাদের চোখে পড়েনি। ওই সময়ের কারিগররা হয়তো সোনার জিনিসপত্র তৈরি করেছে, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখনও আবিষ্কার করতে পারেননি। তবে আর্ব-সাতুলোর মনে এ প্রশ্নের একটা বিকল্প উত্তর আসে: ককেশাসের গোষ্ঠীগুলো সম্ভবত প্রায় ১ হাজার বছর সোনার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এ সময় মূল্যবান এই ধাতুর ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তারা।
নিজের ধারণা সত্যি কি না জানার জন্য দক্ষিণ ককেশাসের সমস্ত স্বর্ণনির্মিত শিল্পকর্মের তথ্যভান্ডার তৈরি করবেন। ৪০০০ থেকে ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সমস্ত শিল্পকর্ম ঠাঁই পাবে এ তালিকায়। অর্থাৎ ওই জাদুঘরে যে আমলে জিনিসপত্র দেখেছিলেন, এরচেয়েও প্রাচীন আমলের জিনিস খুঁজতে হবে তাকে।
২০১৯ সালে বর্তমান জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজের খবরের পেপার কাটিং জোগাড়ে লেগে পড়েন আর্ব-সাতুলো। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমস্ত পেপার কাটিং জোগাড় করেন তিনি। ২০২০ সালের শেষ দিকে তিনি মোট ৮৯টি সাইট ও ৪ হাজার ৫৫টি সোনার জিনিসের তথ্যভান্ডার গড়ে তোলেন। স্বর্ণনির্মিত জিনিসগুলোর মধ্যে আছে পেয়ালা, ছোট ভাস্কর্য, পুঁতি ও সোনার মোড়ক। ভৌগোলিক অঞ্চল ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে সোনার আকরিকের মজুতখানার দূরত্বের ভিত্তিতে এই শিল্পকর্মগুলোকে সাজান আর্ব-সাতুলো।
জর্জিয়ান জাদুঘরগুলোতে আর্ব-সাতুলো দেখেছিলেন ১৫০০ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়কালের স্বর্ণনির্মিত জিনিস খুব কমই আছে। শিল্পকর্মের তালিকা করার পর তিনি দেখলেন, সোনার জিনিসের সংখ্যা কমে গিয়েছিল উত্তর-পশ্চিমের মধ্য-কুরা অঞ্চলে। মধ্য-কুরা অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলো ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের। এ সময়কালের ১ হাজার ২০৯টি স্বর্ণনির্মিত জিনিস পাওয়া গেছে অঞ্চলটির বিভিন্ন সাইট থেকে। কিন্তু এ অঞ্চলের সাইটগুলোতে ১৫০০ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ সময়কালের স্বর্ণনির্মিত জিনিস পাওয়া গেছে মাত্র ২৯টি। এ সময়কালের কার্নেলিয়ান ও অন্যান্য মূল্যবান উপকরণনির্মিত ধাতু অনেকগুলো পাওয়া গেলেও সোনা দিয়ে তৈরি জিনিস পাওয়া গেছে খুবই কম। এ সময়কালে মধ্য-কুরা অঞ্চলে সোনা রীতিমতো দুর্লভ হয়ে ওঠে। তবে এ সময়কালে এ অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তর সোনার জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। ওসব অঞ্চলের মানুষ সোনার তৈরি জিনিস সমাধিতে দেওয়ার প্রচলন টিকিয়ে রাখে।
ওই অঞ্চলের মানুষ কেন দামি ধাতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা দুষ্কর। এই সিদ্ধান্তের কারণ জানিয়ে কোনো লিখিত ইতিহাস রেখে যায়নি তারা। তাই তাদের এই স্বর্ণ-বিমুখিতার কারণ হয়তো চিরকালই রহস্য হয়ে থাকবে।
- সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন