মাত্র ৯০ মিনিটে নাৎসিরা চূড়ান্ত করেছিল হলোকাস্টের নীল নকশা!
২০ জানুয়ারি ১৯৪২। বার্লিনের পশ্চিম প্রান্তে, লেজ ওয়ানসির তীরে এক ভিলায় জড়ো হয়েছেন পনেরোজন উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তা। এ সভার আলোচ্য বিষয়বস্তু: ইউরোপে ইহুদি প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া।
এই সভাতেই চূড়ান্ত করা হয় হলোকাস্টের পরিকল্পনা। আর এই নীলনকশা চূড়ান্ত করতে সময় লেগেছিল মাত্র ৯০ মিনিট।
ওই সভার আলোচ্যবিষয়ের ১৫ পৃষ্ঠার বিবরণীতে সরাসরি হত্যার কথা একবারও উল্লেখ করা হয়নি। ওই বিবরণীতে ব্যবহার করা হয়েছে 'অপসারণ', 'হ্রাসকরণ', 'ব্যবস্থা নেওয়া'—এরকম শব্দ। আর এ কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এবং 'সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের' মধ্যে।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত হলোকাস্ট বিশেষজ্ঞ ডেবোরা ই. লিপস্ট্যাড বলেন, 'প্রটোকলটা পড়ে দেখুন, আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। পুরোটাই লেখা হয়েছে ছদ্মবেশী ভাষায়। এরপর যেব দেশ আর ইহুদিদের হত্যার পরিকল্পনা ওরা করেছিল, সেই তালিকা দেখুন। লাখ লাখ মানুষ খুন করতে যাচ্ছিল ওরা। বিশাল পরিকল্পনা ছিল ওদের।'
ওয়ানসির ওই সভার ৮০ বছর পর ফের ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ইহুদি বিদ্বেষ ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের বীজ। বাড়ছে ইহুদি ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা। কদিন আগেই টেক্সাসে তিন সঙ্গীসহ অপহৃত হন একজন র্যাবাই।
ইহুদি বিদ্বেষজনিত অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে জার্মানিতেও। কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, কট্টর ডানপন্থা ও সন্ত্রাসবাদই গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
যাহোক, ওয়ানসি বৈঠক হয়েছিল যে ভিলায়, সেটি আজও টিকে আছে অনেকটাই অবিকৃত অবস্থায়। এই ভবনটির কী গতি করবে তা নিয়ে, দশকের পর দশক ধরে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছে পশ্চিম জার্মানি কর্তৃপক্ষ। অনেকেই সরকারকে চাপ দিয়েছে, যেন এ ভিলায় হলোকাস্টের নানা তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করা হয়। কেউ কেউ বলেছে, এ কাজ করলে ভিলাটি নাৎসিবাদীদের জন্য তীর্থস্থান হয়ে উঠবে। কাজেই হলোকাস্টের আতঙ্কের কোনো স্মৃতি না রাখাই উত্তম।
এই ভিলাকে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জোসেফ উল্ফ নামে এক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ। উল্ফ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদি। নিজের লেখার ডেস্কের ওপর হিব্রুতে একটি চিরকুট রাখেন তিনি সবসময়। তাতে নাৎসিদের হাতে নিহত ষাট লাখ ইহুদির কথা লেখা আছে—'মনে রেখো!!! ৬,০০০,০০০।'
উল্ফের আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখেনি। এ নিয়ে ছেলের কাছে ১৯৭৪ সালে লেখা চিঠিতে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, 'সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও গণহত্যাকারীরা বুক ফুলিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারে।'
এ চিঠি লেখার কয়েক মাস বাদেই আত্মহত্যা করেন উল্ফ।
১৯৮০-র দশক পর্যন্ত ওয়ানসি সভার ভিলাটি স্কুল ট্রিপে যাওয়া তরুণদের হোস্টেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৯২ সালে দুই জার্মানি এক হওয়ার পর ভবনটি স্মৃতিসৌধ হিসেবে খুলে দেওয়া হয়।
১৯৪২ সালের ওয়ানসির সভার আয়োজক ছিলেন রাইনহার্ড হেইড্রিখ। এসএস ও নিরাপত্তা বিভাগের ক্ষমতাধর প্রধান। হিটলারের ডান হাত হেরমান গোরিং তাকে 'চূড়ান্ত সমাধানে'র এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
ওই সভায় সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা ও পার্টি নেতাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন হেইড্রিখ। তাদের বেশিরভাগের বয়সই ছিল ত্রিশের কোঠায়। তাদের নয়জন ছিলেন আইনের ডিগ্রিধারী, অর্ধেকের বেশি ছিলেন পিএইচডি ডিগ্রিধারী।
অবশ্য ওয়ানসি সভা যখন শুরু হয়, ততদিনে গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। পশ্চিমাঞ্চলে চলছে ইহুদি বিতাড়ণ ও গণহত্যা। তবে সেদিনের সভার ফলে সারা দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যার বন্দোবস্ত করে ফেলা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের 'জুয়িশ অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড এভিকশন' বিভাগের প্রধান অ্যাডলফ আইখমান—পরবর্তীতে তার ব্যবস্থাপনায় ইহুদিদের মরণশিবিরে নেওয়ার আয়োজন করা হয়—ওই সভার বিবরণী লেখেন। ১৫ পৃষ্ঠার ওই বিবরণীর মাত্র ৩০টি কপি করা হয়েছিল। পুস্তিকার প্রথম পৃষ্ঠায় লাল কালিতে লেখা ছিল 'গোপনীয়'। ৩০টি কপি থেকে মাত্র একটি কপি এখনও টিকে আছে। এই কপিটি যুদ্ধের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মার্কিন সৈন্যরা খুঁজে পায়।
আইখমানের পুস্তিকায় ইউরোপে মোট ইহুদি জনসংখ্যার বিস্তারিত উঠে আসে। এতে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডের ইহুদিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইহুদি সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান কেমন হবে, তার একটা রূপরেখা দেওয়া হয় কার্যবিবরণীতে।
তাতে বলা হয়, যথাযথ তত্ত্বাবধানে ইহুদিদের পুবে একটি টেকসই উপায়ে কাজে লাগানো হবে। কর্মক্ষম ইহুদিদের সড়ক নির্মাণ করতে পাঠানো হবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিকভাবেই ইহুদিদের বড় একটা সংখ্যা কমে যাবে। এরপর যারা টিকে থাকবে, তাদের উপযুক্ত দাওয়াই দেওয়া হবে।
ইহুদি-বিনাশের ওই নীল নকশায় বলা হয়, ইহুদিদের প্রথমে দলে দলে ভাগ করে তথাকথিত ট্রানজিট ঘেটোগুলোতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে পুবে। ইউরোপের যেসব অঞ্চলে জার্মানির নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবে রয়েছে, সেখানে চূড়ান্ত সমাধান প্রয়োগ করা হবে।
আমলাতন্ত্রের ভাষায় লেখা হলেও কার্যবিবরণীর বক্তব্য বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়—'ইউরোপীয় ইহুদিদের ঝাড়ে-বংশে হত্যা করা'। হিটলারের প্রধান প্রোপাগ্যান্ডিস্ট জোসেফ গোয়েবল ওই কার্যবিবরণী পড়ে নিজের ডায়েরিতে এ কথা লিখেছিলেন।
ওয়ানসি সভায় হাজির থাকা ১৫ ব্যক্তি হলোকাস্টে সরাসরি অংশ নেন। তাদের কয়েকজন মার্ডার স্কোয়াডের নেতৃত্ব দিতেন, বাকিরা গণহত্যার আইনি কাঠামো তৈরি করেন।
তাদের ছয়জন ১৯৪৫ সালের মধ্যে মারা যান। মাত্র দুজন যুদ্ধের পর হলোকাস্টে অংশ নেওয়ার জন্য বিচারের মুখোমুখি হন। বহু বছর আর্জেন্টিনায় পলাতক থাকার পর ইসরায়েলে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আইখমান। নুরেমবার্গ রেস ল'র সহলেখক উইলহেলম স্টুকার্ট ১৯৪৯ সালে মুক্তি পান।
আরও তিনজনের বিচার করে লঘু দণ্ড দেওয়া হয়। আর চারজনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আনা হয়নি কখনও। যুদ্ধের পর বহু বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করে যান হিটলারের সিনিয়র কর্মকর্তা গেরহার্ড ক্লোফার।
গেরহার্ড মারা যান ১৯৮৭ সালে। তার মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যরা একটি ডেথ নোটিস প্রকাশ করে। তাতে লেখা ছিল, নিজের যাপিত জীবন নিয়ে তিনি তৃপ্ত। পরিপূর্ণ জীবন যাপন করেছেন তিনি—এবং অনেকের উপকার করেছেন!
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস