পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচা মানুষরা খায় যে ৮ ধরনের ফাইবারযুক্ত খাবার
আপনি যদি একটি দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন কামনা করেন, সেক্ষেত্রে আপনার রোজকার খাবারে যে উপাদানটির উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি, তা হলো ফাইবার বা আঁশ।
বিশ্বের যেসব অঞ্চলে মানুষ সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচে, সেগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে ব্লু জোন হিসেবে। এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্লু জোনের মানুষদের খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেটসহ ফাইবার সমৃদ্ধ বিভিন্ন খাবার থাকে।
ব্লু জোনের খাবার বলতে আমরা প্রধানত বোঝাতে পারি জাপানি, গ্রিক, ইটালিয়ান ও কোস্টারিকান অঞ্চলের খাবারকে। এই সবগুলো অঞ্চলেই যে একই রকম খাবার খাওয়া হয়, তা হয়তো নয়। তবে কিছু হাই-ফাইবার খাবার যেমন বিন, বাদাম, গোটাশস্য, বনৌষধি লতাপাতা, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদিরই আধিপত্য দেখা যায় ব্লু জোনের খাদ্যতালিকায়।
গবেষণা মতে, পর্যাপ্ত পরিমাণ ফাইবার গুরুত্বপূর্ণ খাবার ঠিকভাবে হজম করতে, রক্তে সুগারের মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে, এবং হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো ক্রনিক রোগ প্রতিরোধে। তাছাড়া যেসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে, সেগুলো পরিমিত পরিমাণে খেলেই দীর্ঘসময় পেট ভরে থাকে। ফলে বারবার ক্ষুধা লাগে না, আর বেশি খাওয়ার মাধ্যমে ওজন বৃদ্ধি বা স্থূলতার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়।
তাই ফাইবারের সর্বোচ্চ ফায়দা তোলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন পরামর্শ দিয়েছে প্রতিদিন গড়ে ২৮ গ্রাম ফাইবার গ্রহণের (অথবা ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজনীয় ক্যালরির উপর ভিত্তি করে সেটি ২১ থেকে ৩৮ গ্রামও হতে পারে)।
বাদাম ও বীজ
অতিরিক্ত ক্যালরির কারণে ডায়েট জগতে বাদাম ও বীজের যথেষ্ট দুর্নাম রয়েছে। কিন্তু এগুলোতে বিপুল পরিমাণে পুষ্টিগুণও রয়েছে, এবং সেইসঙ্গে রয়েছে প্রচুর ফাইবার।
"আগে বাদামকে অস্বাস্থ্যকর বলে ভাবা হতো। কিন্তু আসলে ওগুলো হলো আপনার মুখে পোরার মতো অন্যতম সেরা খাবার," বলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. রবার্ট লাস্টিগ।
আপনার শরীরের প্রতিদিন যে পরিমাণ ফাইবার প্রয়োজন, তার এক-দশমাংশই পাওয়া যায় প্রতি এক আউন্স কাঠবাদাম, পেস্তা বাদাম, পাইন বাদাম বা পেকান থেকে।
এদিকে চিয়া বীজে রয়েছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ফাইবার। মাত্র দুই চা চামচ চিয়া বীজ থেকেই আপনি পেয়ে যাবেন রোজকার প্রয়োজনীয় ফাইবারের ৩৫ শতাংশ।
প্রতি এক আউন্স তিসি বা কুমড়ার বীজ থেকেও আপনি পেতে পারেন প্রতিদিনের চাহিদার যথাক্রমে ২৮ ও ১৯ শতাংশ ফাইবার।
বিন
ব্লু জোনের স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ বিন। ব্লু জোনের ডায়েটকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলা ড্যান বুয়েটনার পরামর্শ দেন প্রতিদিন অন্তত আধাকাপ বিন খাওয়ার।
ব্ল্যাক বিন থেকে শুরু করে ছোট ছোট লাল মুগডাল, কিংবা সাধারণ সয়াবিন বা অপরিণত উজ্জ্বল সবুজ সয়াবিন, সব মিলিয়ে বিনের অনেকগুলো ধরন রয়েছে। এরা সকলেই ফাইবারযুক্ত। এছাড়াও এগুলোতে রয়েছে প্রোটিনসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান।
ক্রুসিফেরাস সবজি
ক্রুসিফেরাস প্রজাতির সবজির মধ্যে রয়েছে ব্রকোলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি। এগুলোকে পুষ্টির পাওয়ারহাউজও বলা হয়ে থাকে, কেননা এগুলোতে রয়েছে ভিটামিন ১ ও সি, পলিফেনল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইত্যাদি।
সেইসঙ্গে এসব সবজিতে রয়েছে ফাইবারও। গড়ে প্রতি কাপে পাঁচ গ্রাম করে ফাইবার পাওয়া যায়। তাই এগুলোকে আপনি সালাদ বানিয়েই খান কিংবা ভেজে বা রান্না করে, প্রাত্যহিক ফাইবারের চাহিদার অনেকটাই মিটবে নিঃসন্দেহে।
গোটাশস্য
গোটাশস্য বা হোল গ্রেইন খুবই সীমিত পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত হয়ে থাকে। ফলে এগুলোতে গাছের পুষ্টি উপাদানগুলোর অধিকাংশই সঞ্চিত থাকে। ফলে ফাইবারের পরিমাণও অন্য বেশিরভাগ খাবারের চেয়ে গোটাশস্যে বেশি।
যেসব গোটাশস্যে সবচেয়ে বেশি ফাইবার থাকে :
বুলগুর গম : প্রতি কাপে ৮ গ্রাম
বার্লি : প্রতি কাপে ৬ গ্রাম
কুইনোয়া : প্রতি গ্রামে ৫ গ্রাম
ওটমিল : প্রতি কাপে ৪ গ্রাম
বাদামি চাল : প্রতি কাপে ৪ গ্রাম
গোটাশস্যে শরীরের জন্য দরকারি অ্যামাইনো অ্যাসিডও রয়েছে। তাই আপনি যদি গোটাশস্য ও বিন একসঙ্গে খান, সেটি হতে পারে আপনার পূর্ণাঙ্গ প্রোটিনের উৎস।
ব্লু জোন ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেই ভাতের সঙ্গে বিন দিয়ে রাঁধা ডিশ অনেক জনপ্রিয়।
রুটি
রুটি হলো এমন আরেকটি খাবার যাকে বিভিন্ন ডায়েট সার্কেলেই বেশ ভয়ের চোখে দেখা হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, রুটিকে ভয়ের কিছু নেই।
যদি ঠিকভাবে প্রস্তুত করা হয়, তাহলে রুটিও হতে পারে ফাইবারের একটি খুব ভালো উৎস। তবে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে, আপনি কোন ধরনের রুটি বাছাই করছেন।
সাদা রুটি অনেক বেশি পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত হয়। ফলে এর যাবতীয় পুষ্টি গুণাগুণই হারিয়ে যায়। কিন্তু গোটাশস্য ও গমজাতীয় খাবারে তাদের প্রকৃত পুষ্টি গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ছাড়াও সেগুলোতে থাকে ভিটামিন ও মিনারেল।
এদিকে ফারমেন্টেশন বা গাঁজনের মাধ্যমে যেসব রুটি তৈরি হয়, সেগুলোর উপকারিতা আরো বেশি। ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় রুটির অভ্যন্তরের পুষ্টি উপাদানগুলো ভেঙ্গে যায় বলে সেগুলো সহজেই হজম করা যায়।
আপনি যদি দ্বিগুণ পরিমাণ ফাইবার চান, তাহলে বীজের রুটিও খেয়ে দেখতে পারেন।
ভূ-গর্ভস্থ সবজি
ব্লু জোন ডায়েটের সব সবজিই যে সবুজ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই পরামর্শ দিয়ে থাকেন রঙ-বেরঙের শাকসবজি খাওয়ার, যেন খাবারের পুষ্টি গুণাগুণে বৈচিত্র্য আসে। উজ্জ্বলরঙা কমলা ও হলুদ রঙের ভূ-গর্ভস্থ সবজি আপনার ফাইবারের চাহিদা মেটাতে পারে।
যেমন ধরা যেতে পারে মিষ্টি আলুর কথা। কমলা রঙেরও মিষ্টি আলু রয়েছে, কিন্তু বেগুনি-সাদা রঙ্গের যে ভিন্নধর্মী প্রজাতিটি জাপানের ওকিনাওয়ায় পাওয়া যায়, সেগুলোর প্রতিটিতে প্রায় ৪.৬ গ্রাম করে ফাইবার থাকে।
ফল
যেহেতু ব্লু জোন পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল নয়, বরং গোটা পৃথিবীজুড়েই অঞ্চলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাই সেগুলোতে প্রাপ্ত ফলফলাদিও অনেক বৈচিত্র্যময়।
যেমন ইটালি ও গ্রিসের জনপ্রিয় ফলের মধ্যে রয়েছে খেজুর, ডুমুর, খুবানি ইত্যাদি। অন্যদিকে কোস্টারিকানদের প্রিয় ফলের মধ্যে রয়েছে পেঁপে, কলা, আনারস।
এই ফলগুলোর প্রতিটিতেই রয়েছে ফাইবারের প্রাচুর্য। তাছাড়া ভিটামিস সি, পটাশিয়াম, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি পুষ্টি গুণাগুণেও এসব ফল সমৃদ্ধ।
পৃথিবীর প্রায় সবখানেই পাওয়া যায় এবং প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে এমন ফলগুলো হলো ;
রাস্পবেরি : প্রতি কাপে ৮ গ্রাম
সাইট্রাস : প্রতি কাপ কমলায় প্রায় ৪ গ্রাম
আপেল : মাঝারি আকারের প্রতিটি ফলে প্রায় ৪ গ্রাম
ব্লুবেরি : প্রতি কাপে ৫ গ্রাম
স্ট্রবেরি : প্রতি কাপে ৩ গ্রাম
বনৌষধি ও মসলা
ব্লু জোন অঞ্চলগুলোর সমৃদ্ধ খাদ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে রয়েছে নানা স্বাদ ও গন্ধের মসলা ও বনৌষধিও। তরকারির স্বাদ বৃদ্ধির পাশাপাশি এগুলো জোগাতে পারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফাইবারও।
বিভিন্ন ব্লু জোনের রেসিপিতেই জংলী মরুয়া, রোজমেরি, পুদিনা পাতা ও মৌরির উপস্থিতি দেখা যায়। এছাড়া খাবারে খানিকটা বাড়তি ফাইবার পেতে তরতাজা ধনেপাতা বা ঋষি পাতাও (সেজ লিফ) যোগ করা যেতে পারে।
যদিও বনৌষধি লতাপাতা ও মসলা খাবারে খুব সামান্য পরিমাণেই যোগ করা হয়, যার ফলে শুধু সেগুলো থেকেই অনেক বেশি পরিমাণ ফাইবার বা ভিটামিন আশা করা বোকামি, তারপরও সেগুলো আপনার খাবারের সামগ্রিক পুষ্টি গুণাগুণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
- সূত্র: ইনসাইডার