যেভাবে বেগম বাড়ি হয়ে উঠল শ্যুটিং বাড়ি
চারপাশে দেয়ালে ঘেরা বাড়িটার সামনে বেশ ফাঁকা জায়গা। সেখানে একটা পাকুড় ও নিমগাছ। ফাঁকা জায়গায় এলোমেলো ইটের টুকরা বিছানো। সেটা পেরিয়ে সামনে এগোলেই বারান্দা। তবে বারান্দায় উঠতে হয় গ্রিলের গেট পেরিয়ে। বাড়ির দুই পাশে কালো রংয়ের ওপর সাদা হরফে বাংলা ও ইংরেজিতে একপাশে লেখা রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই একাডেমি, আরেকপাশে নূরজাহান বেগম স্মৃতি সংসদ। আর মাঝ বরাবর খানিকটা ওপরের দিকে লেখা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন স্মৃতি ভবন। বাড়িতে ঢুকতেই এমন লেখা দেখে চমকে যেতে হয়। এই বাড়িটা আসলে কাদের?
যারা দেশের পত্রপত্রিকার ইতিহাস সম্পর্কে জানেন, তারা অনায়াসে নামগুলো মনে করতে পারেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন উপমহাদেশের অন্যতম সাহিত্য মাসিক পত্রিকা 'সওগাতে'র সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৮ সালে কলকাতা থেকে এই পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। তার মেয়ে নূরজাহান বেগম ছিলেন এই উপমহাদেশের নারীদের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার সম্পাদক। অবশ্য বেগম পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই যখন নূরজাহান বেগম বিএ শ্রেণীতে পড়তেন। তার বাবা নাসিরউদ্দিন প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। প্রথম চার মাস সম্পাদক হিসেবে এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
নূরজাহান বেগমের মতো যারা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ও লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে পড়তেন তারা সবাই মিলে বেগম-এর জন্য কাজ করতেন। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তিনি বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খানকে (দাদাভাই)। ১৯৫০ সালে বাংলাদেশে চলে আসেন তারা। ১৯৫০ সালে এসে তারা যে বাড়িতে ওঠেন সেই বাড়ির গল্পই বলা হলো শুরুতে। যার প্রতিটি দেয়াল, ইট, রেলিং জুড়ে নাসিরউদ্দিন, নূরজাহান বেগম এবং দাদাভাইয়ের স্মৃতি। আছে বেগম পত্রিকারও স্মৃতি।
রাজধানীর পুরান ঢাকার শরৎগুপ্ত স্ট্রিটের ৩৮ নম্বর বাড়িটিতে প্রায় ৬৪ বছর ধরে বসবাস করেছেন নূরজাহান বেগম ও তার পরিবার। ২০১৬ সালের ২৩ মে মৃত্যুবরণ করেন নারীদের অগ্রযাত্রার পথিকৃত মহীয়সী এই নারী।
তার মৃত্যুর পর থেকেই নারিন্দার এই বাড়িটি ব্যবহৃত হচ্ছে শ্যুটিং বাড়ি হিসেবে। মাসের প্রায় ১৫-২০ দিন শ্যুটিং করা হয় এখানে। পুরোনো ঢাকার নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনের দৃশ্যধারণের প্রয়োজন হলেই পরিচালকেরা এই বাড়িতে ভিড় করেন।
জানা গেছে, দৃষ্টিনন্দন এই বাড়িটির বয়স প্রায় ১২৫ বছর। নূরজাহান বেগমের বাবা নাসিরউদ্দিন ১৯৫০ সালে কলকাতার বাড়িটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে এই বাড়িতে এসে ওঠেন। প্রায় ১৬ কাঠা জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়িটিতে এখন কোন ফার্নিচার রাখা হয় না। পরিচালকেরা শ্যুটিং করার সময় ফার্নিচার বানিয়ে নেন বা ভাড়া করে নেন।
বাড়ির কেয়ারটেকার জানান, তিনি বছরখানেক হলো এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায়ই শ্যুটিং হয় এই বাড়িতে। নাটকের শ্যুটিংয়ের জন্য দিনপ্রতি আট হাজার ও বিজ্ঞাপনের শ্যুটিংয়ের জন্য দশ হাজার টাকা নেয়া হয়।
পুরো বাড়িটি ঘুরে দেখা যায়, বাড়ির সামনে ও পেছনে বেশ ফাঁকা জায়গা। সেখানে নানা জাতের গাছগাছালিতে ভরপুর। দোতলা বাড়িটার নিচতলা, দোতলা এবং ছাদে শ্যুটিং করা যায়। পাশাপাশি কেউ চাইলে বাড়ির পেছনের অংশ ও সামনের অংশে শ্যুটিং করতে পারেন।
কিছুদিন আগেই এ বাড়িতে শ্যুটিং করেছেন নির্মাতা সঞ্জয় সমাদ্দার। 'অমানুষ' ও 'মরণোত্তম' নামে দুটি কনটেন্টের শুটিং করেন এখানে। তিনি বলেন, "এরকম একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়িতে শ্যুটিং করা আমার জন্য আনন্দের। তবে আমার চাওয়া যারা শ্যুটিং করবেন তারা যেন একটু যত্নশীল হোন এবং যারা বাড়িটির দায়িত্বে আছেন তারাও যেন এই বাড়িটি সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেন।"
বর্তমানে বাড়িটির দায়িত্বে আছেন নূরজাহান বেগমের নাতনি প্রিয়তা ইফতেখার। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে বলেন, "বাড়িটিতে আমার নানুর স্মৃতি আছে এটা ঠিক। কিন্তু এই ধরনের বাড়ি সংরক্ষণ ও যত্ন করতেও তো খরচ হয়। একইসঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করাও কঠিন। প্রতিনিয়ত বাড়িটি নিয়ে একধরনের টেনশনে থাকি। আমার বাসা বনানী। সেখান থেকে যথাযথ দেখভাল করাও যায় না। আর বাড়িটির অবস্থাও অতটা ভালো না। দেয়ালের পলেস্তারা এমনকি রেলিংগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এসব জেনেও অনেক সময় শ্যুটিংয়ের জন্য পরিচালকেরা ব্যবহার করেন এটি।"
বাড়িটি নিয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে প্রিয়তা বলেন, "এখনো কিছু ভাবছি না। এটা আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত। তবে দুঃখ হলো, নূরজাহান বেগমের নামে কোনো রাস্তা বা মিলনায়তন নেই। একটা স্কুল নেই। যে মানুষটাকে আমরা ঠিকঠাক স্মরণ করি না, তার বাড়ি দিয়ে আর কী হবে। অনেকে বাড়িটাকে মিউজিয়াম বানানোর কথা বলছেন। সেটা নিয়েও চিন্তা করছি।"