যে যতো ভালো গণিত পারে, অর্থ উপার্জন তাকে ততো বেশি তৃপ্তি দেয়
স্কুলে থাকতে আপনার গণিত শিক্ষক হয়তো বলেছিলেন বড় হয়ে অনেক কাজে লাগবে গণিতের দক্ষতা। কিন্তু সে সময় হয়তো আপনি সে কথা আমলেই নেননি। তা হতেই পারে, শৈশবে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার চাপে শিশুমন অভিভাবকসুলভ অনেক কথাতেই আস্থা পায়না। কিন্তু, বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে স্কুল শিক্ষকদের ওই কথা ঠিকই ছিল।
মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার প্রভাব কীভাবে তার উপার্জিত সম্পদের ওপর পরে, এমনকি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সুখী থাকার ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে তা উঠে এসেছে এ গবেষণায়। ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত যে সব মানুষ গণিত ভালো পারে তাদের উপার্জন বেশি, ব্যক্তিজীবনে তারা বেশি সুখীও হয়। তবে এর উল্টোদিকও কিন্তু আছে।
গণিত ভালো পারে এমন মানুষরা তাদের উপার্জন নিয়ে সুখী থাকলেও, কম উপার্জন করলে গণিতে ভালো না এমন মানুষের চেয়ে তারা বেশি মানসিক পীড়ায় ভোগে।
অনেক গবেষণায় এও দেখা গেছে, বেশি উপার্জন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই মানুষকে সুখী রাখতে পারে, তৃপ্তি দিতে পারে। এই বিষয়টিকেই কাজে লাগিয়ে গবেষণায় দেখানো হয়েছে একজন মানুষ গণিতে কতোটা ভালো তার ওপর নির্ভর করছে তার উপার্জনের তৃপ্তি।
গণিত আর সুখী থাকার টেস্ট
আন্ডারস্ট্যান্ডিং আমেরিকা স্টাডি'র অংশ হিসেবে ৫,৭৪৮ জন আমেরিকানের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষকরা গণিতের দক্ষতা, উপার্জন আর জীবনের তৃপ্তির সঙ্গে সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করেছেন।
গবেষণাটিতে দুইটি প্রশ্ন ছিল, গবেষণা সম্পর্কিত আরেকটি টেস্ট ছিল। একটি প্রশ্ন ছিল প্রতিটি পরিবারের বার্ষিক আয় কতো। আরেকটি প্রশ্ন ছিল এক থেকে দশের মধ্যে তারা তাদের জীবন নিয়ে কতোটুকু তৃপ্ত।
সবশেষে, অংশগ্রহণকারীদের আটটি গণিতের সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হয়।
এগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক বোঝার জন্য সব তথ্য একত্র করেন তারা। গণিতের দক্ষতা আর উপার্জন কোনো মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা এমনকি মৌখিক বুদ্ধিমত্তা আর ব্যক্তিসত্ত্বার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
উপার্জন আর তৃপ্তির সঙ্গে গণিতের দক্ষতার সম্পর্ক
গড়ে একজন মানুষ গণিতে যত ভালো থাকে তার উপার্জন ততো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গবেষণার টেস্টে যারা অন্তত একটি বেশি সঠিক উত্তর দিয়েছে তাদের গড় বার্ষিক আয় ৪,০৬২ ডলার বেশি।
ধরুন, দুজন মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা একই, এরমধ্যে একজন একটি প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর দেননি। আরেকজন সবগুলো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছে। এই গবেষণা এক্ষেত্রে বলছে, যে ব্যক্তিটি সবগুলো সঠিক উত্তর দিয়েছে তার বার্ষিক উপার্জন হবে ৩০ হাজার ডলারের বেশি।
এই জরিপে আরও দেখা গেছে, গণিতে দক্ষ ব্যক্তিরা গড় হিসাবে তাদের জীবন নিয়ে বেশি তৃপ্ত। অন্যান্য আরও অনেক গবেষণার সঙ্গে এই গবেষণার ফলাফলের সাদৃশ্য দেখা গেছে।
তবে পূর্ববর্তী আরও অনেক গবেষণা বলছে, উপার্জন আর তৃপ্তির সম্পর্ক এতোটাও সরলরৈখিক না। বেশি টাকাই বেশি সুখ এনে দেয় বিষয়টি শতভাগ সত্যি এরকমও নয়। দেখা গেছে, মানুষ তার উপার্জন নিয়ে কতোটুকু তৃপ্ত তা অনেক সময়ই নির্ভর করে তারা অন্যের উপার্জনের ব্যাপারে কেমন ধারণা রাখে।
অন্যান্য আরও গবেষণায় দেখা গেছে, গণিতে দক্ষ ব্যক্তিরা সাধারণভাবেই সংখ্যার মধ্যে তুলনা করতে থাকেন। এ বিষয় দেখেই গবেষকরা চিন্তা করলেন গণিতে দক্ষ ব্যক্তিরা নিজেদের উপার্জন অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে দেখবে। গবেষণার ফলাফলেও এই বিষয়টিই দেখা গেছে।
সহজ কথায়, একজন মানুষ গণিতে যতো বেশি ভালো, তারা নিজেদের উপার্জন নিয়ে ততো বেশি সচেতন থাকে। গণিতে দক্ষরাই বেশি উপার্জন করলে জীবন নিয়ে বেশি তৃপ্ত থাকেন।
কিন্তু এই প্রবণতার খারাপ দিকও আছে বটে। উপার্জন কম থাকলে এসব মানুষই আবার জীবন নিয়ে সবচেয়ে কম তৃপ্ত থাকে। এরমধ্যে যে সব মানুষ গণিতে কম দক্ষ তাদের জীবনে তৃপ্তির সঙ্গে উপার্জনের সম্পর্ক তেমন নেই।
অর্থই সুখের কারণ অনেকের
গবেষণালব্ধ একটি প্রচলিত কথা প্রায় শোনা যায়। একজন মানুষ একবার যদি প্রতি বছর ৯৫ হাজার ডলার উপার্জন শুরু করে, উপার্জন আর সেভাবে তাকে তৃপ্তি দিতে পারে না। এই ধারণার প্রতিই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে গবেষণাটি।
গণিতে দক্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায় না। যতো বেশি উপার্জন, তারা ততো বেশি তৃপ্ত হন, সুখী থাকেন। উপার্জনের কোনো নির্দিষ্ট সীমায় তাদের আকাঙ্ক্ষা বাধা থাকে না। কিন্তু, এটিই আবার গণিতে ভালো না এমন মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। একজন মানুষ গণিতে যতো কম দক্ষ, ৫০ হাজার ডলার উপার্জনের সীমা পর্যন্ত তাদের তৃপ্তিও বাড়তে থাকে। আয় ৫০ হাজার ডলার ছাড়ালেও তাদের চিন্তায় পার্থক্য খুব কমই দেখা যায়।
অনেকের ক্ষেত্রে আবার বিষয়টি অন্যরকম। শুধু উপার্জন তাদের সুখী করে না। এ বিষয়টি কেন হয় এব্যাপারেই বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। গবেষকদের মতে, গণিতে দক্ষ মানুষ সংখ্যার তুলনা করেন, উপার্জনের ক্ষেত্রেও। এ বিষয়টিই হয়তো সবসময় ভালো ফল বয়ে আনে না। সে তুলনায়, গণিতে অদক্ষ মানুষ উপার্জন ছাড়াও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সুখ খুঁজে নিতে চেষ্টা করেন। একারণেই আপনি যদি আপনার উপার্জন নিয়ে অসুখী থাকেন, সংখ্যার হিসাব থেকে বের হয়ে আসলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন।
- সূত্র: বিগ থিংক