বিদ্রোহের আগুন জ্বেলেছিল কবিয়াল রমেশ শীলের গান
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি,
ভাই ঢাকা শহর রক্তে রাঙাইলি।
ব্রিটিশ যুগে চালাইতো ভাই হাঁটুর নিচে গুলি
এখন স্বাধীন দেশের ভাই-তে,
ভাইরে উড়ায় মাথার খুলি...ও' ভাই উড়ায় মাথার খুলি।
১৯৫২ সালে কবিয়াল রমেশ শীলের এই গানের জনপ্রিয়তা ছিল কিংবদন্তির মতো। ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস পালন করার সময় সাংবাদিক ওবায়দুল হক ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এ গান গেয়ে গোটা চট্টগ্রাম শহর ঘুরে বেড়ান। তার গাওয়া গান চট্টগ্রামে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমিয়ে ফেলে।
১৯৯৫ সালে 'দৈনিক আজাদী'র ৩৫ বছর পূর্তির বিশেষ সংখ্যায় কবিয়াল রমেশ শীলের বিখ্যাত গানের জনপ্রিয়তাকে এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু এই একটি নয়, ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ট্রাজেডির পর তার রচিত একাধিক গণসঙ্গীত দেশের মানুষদের এইসব সংগ্রামে অংশ নিতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। রমেশ শীল নিজেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে।
১৯৫৪ সালে জণগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। নুরুল আমিনকে বানানো হয় পূর্ব বাংলার গভর্নর। এই নুরুল আমিন চট্টগ্রামে এলে জনগণের কাছে লাঞ্চিত হন। এই নিয়ে তিনি বিখ্যাত একটি ব্যাঙ্গাত্মক গান রচনা করেন।
গানটি হচ্ছে-
শোন ভাই আজগুবি খবর
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন করে চট্টগ্রাম সফর।
.......হঠাৎ দেখি পচা আণ্ডা
মন্ত্রীকে করিতেছে ঠাণ্ডা।
উড়তে লাগলো কাল ঝাণ্ডা,
মন্ত্রীর চোখের উপর।
এ গানের কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়ার পরে রমেশ শীলকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। তার 'ভোট রহস্য' বইটি বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার। কবি দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন ওই সময়ে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করায় রমেশ শীলের সাহিত্য ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই বছর ঢাকায় কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় সহবন্দীরা তাকে সংবর্ধিত করেন।
রমেশ শীল ও ফনী বড়ুয়ার কবিগানের আসর 'যুদ্ধ ও শান্তি' সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "রমেশ শীল ও ফনী বড়ুয়ার কবিগানগুলো এতটা আধুনিক রূপ লাভ করেছিল! ঈশ্বর পাঠশালার চত্বরে মাদুরপাতা, হোগলাপাতায় বসে রাতভর শুনেছিলাম। অসাধারণ ছিল ওই পালা গান।"
কবিয়াল রমেশ শীল ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানার অন্তর্গত গোমদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম চন্ডীচরণ শীল। রমেশ শীলের শৈশব ছিল পিতৃ হারানোর বেদনায় ভরা আর দারিদ্রক্লিষ্ট জীবন। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তিনি হারিয়েছেন তার বাবাকে। পরিবারের সকল দায়িত্ব এসে পড়ে কবির কাঁধে। নরসুন্দর পিতার পেশাকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেন প্রাথমিক জীবনে।
নিজের সে সময়ের অবস্থার কথা তিনি লিখেছেন এভাবে— 'আমিই বালক, চালক, পালক, আমার আর কেহ নাই। মায়ের অলংকার সম্বল আমার, বিক্রি করে খাই।'
একসময় ভাগ্যান্বেষণে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রেঙ্গুন শহরে যান রমেশ শীল। সেখানে একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে একটি দোকানেরও মালিক হন। কিন্তু স্বদেশের প্রতি ভালবাসার টানে পাঁচ বছরের মধ্যেই নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে আগের নরসুন্দর পেশার পাশাপাশি কবিরাজ হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই কবিরাজি করতে করতেই কবিগানের প্রতি তিনি ভীষণভাবে অনুরাগী হয়ে উঠেন।
প্রথমে প্রথাগত কবিগান রচনার মাধ্যমে রচনা শুরু করলেও পরে কবিগানের ধরনই পাল্টে দেন। তিনি লিখেছেন প্রচুর মাইজভান্ডারি গানও।
কবি রমেশ শীলের বিষয়বস্তু শেষ পর্যন্ত ছিল মানুষ। সেই মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নে তিনি কাজ করেছেন, কলম ধরেছেন। তার জন্য তিনি পেয়েছিলেন মানুষের ভালোবাসা। জীবদ্দশায় পেয়েছেন প্রচুর সংবর্ধনা। ১৯৬২ সালে বুলবুল একাডেমি ও '৬৪ সালে চট্টগ্রামে নাগরিক সংবর্ধনা লাভ করেন তিনি। কিন্তু তিনি কখনো এসব পুরস্কারের তোয়াক্কা করেননি। প্রতিষ্ঠার কাঙাল ছিলেন না, সারা জীবন প্রতিষ্ঠানের প্রতিকূলে কাজ করেছেন সংগ্রামী চেতনায়। দেশকে ভালোবেসেছেন প্রাণ দিয়ে। ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ